কর্মক্ষেত্র থেকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন তাঁরা, শোকের মাতম
স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণ আর সংসারের চাকা ঘুরানোর জন্য বহুদূরের কর্মক্ষেত্রে যারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করতেন, জীবনের চাকা থেমে যাওয়ার পর আজকে সেসব দরিদ্র শ্রমিকই প্রিয়জনদের কাছে ফিরেছেন লাশ হয়েছে।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ইটভাটায় নিহত ১৩ শ্রমিকের মরদেহ শনিবার সকালে যখন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি ইউনিয়নের কর্ণময়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁচায় তখন সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
আগে থেকেই স্কুল প্রাঙ্গণে প্রশাসনের কাছে থেকে লাশ গ্রহণ করার জন্য সামিয়ানা টাঙানো হয়। ভোর থেকেই শোকগ্রস্ত হাজারো মানুষ এসেছেন শুধু লাশ নিতে। নিহতের পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী সবাই কাঁদছেন। যেন কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না।
সকাল সাড়ে ৯টায় পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তরের কাজ শুরু হয়। পরিবারের সদস্যরা সরকারি খাতায় কেউবা স্বাক্ষর করে, কেউবা টিপসই দিয়ে বুঝে নিয়েছে ভাই, সন্তান বা বাবার লাশ।
কাঠের কফিনে করে এক একজন শ্রমিকের লাশ হস্তান্তর করা হয়। গণনবিদারী কান্নার মধ্য দিয়ে ছয়জন করে মানুষ এক একটি লাশ বহন করে নিয়ে গেছে নিজেদের গ্রামের দিকে, শ্মশানে বা কবরে।
জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন স্বজনদের হাতে সরকারের পক্ষ থেকে ২০ হাজার করে টাকা, শুকনো খাবার ও শীতবস্ত্র তুলে দেন। উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুজাউদ্দৌলা, জলঢাকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজার রহমানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
গতকাল শুক্রবার ভোরে চৌদ্দগ্রামের গোলপাশা ইউনিয়নের নারায়ণপুর এলাকায় এস এম কাজী অ্যান্ড কোং নামে ইটভাটায় ট্রাক থেকে কয়লা আনলোড করা হচ্ছ্লি। এ সময় একটি চাকা ফেটে যায়। তখন ট্রাকটি উল্টে পাশের একটি ঘরের ওপর গিয়ে পড়ে। সেটি এক ধরনের লেবার শেড। এখানেই ইটভাটার শ্রমিকরা মেস করে থাকতেন। এখানে কোনো নিরাপত্তা ছিল না।
এই ঘরে মোট ১৮ জন শ্রমিক থাকতেন। তাঁদের মধ্যে একজন ঘরে ছিলেন না। দুর্ঘটনার পর দুজন বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। আর বাকি ১৫ জন ঘুমে ছিলেন। মূলত কয়লা গিয়েই ঘুমন্ত শ্রমিকদের ওপর পড়ে। শীতের মধ্যে শ্রমিকরা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। তার ওপর কয়লা পড়ে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, এক ধরনের শ্বাসরোধ হয়ে তাঁরা মারা গেছেন বলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে ১০জন সনাতন ধর্মাবলম্বী আর বাকি তিনজন মুসলিম। তাঁরা হলেন—কনক চন্দ্র রায়, বিকাশ চন্দ্র রায়, মিলন চন্দ্র রায়, দিপু চন্দ্র রায়, রঞ্জিত চন্দ্র রায়, মনোরঞ্জন চন্দ্র রায়, অমিত চন্দ্র রায়, শংকর চন্দ্র রায়, বিপ্লব চন্দ্র রায়, তরুণ চন্দ্র রায়, মো. মাসুদ, মো. মোরসালিন ও মো. সেলিম। সবার বাড়ি নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার রাজবাড়ী, শিমুলবাড়ী, দিবাড়িয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে।
আজ সকালে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ঘোষণা দিয়েছেন, নিহত প্রত্যেক শ্রমিকদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আর এ দুর্ঘটনায় আহতরা প্রত্যেকে চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে পাবেন।’