২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় প্রথম জামিন দুই আইজিপির
চাঞ্চল্যকর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় রায় ঘোষণার পর এই প্রথম সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক দুই মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহুদুল হক ও আশরাফুল হুদাকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে আজ সোমবার বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়াল ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ছয় মাসের জামিনের আদেশ দেন।
আদালতে আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন আশরাদুর রউফ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এফ আর খান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
এ বিষয়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাংবাদিকদের বলেন, গ্রেনেড হামলা মামলায় দুই বছরের সাজার রায় হলেও আসামিরা ১৪ মাস ধরে বিচার পর্যায়ে কারাগারে ছিলেন। সেদিক বিবেচনায় নিয়ে বিচারিক আদালত তাঁদের জামিন দিয়েছেন। তবে এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, গত বছরের ১০ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। ৪৯ আসামির মধ্যে বাকি ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
ফাঁসির ১৯ আসামি হলেন—লুৎফুজ্জামান বাবর (উপস্থিত), মাওলানা তাজউদ্দিন (পলাতক), শেখ আবদুস সালাম (উপস্থিত), মো. আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট (উপস্থিত), আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম (উপস্থিত), মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ (উপস্থিত), মহিব্বুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি (উপস্থিত), মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর (উপস্থিত), আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল (উপস্থিত), মো. জাহাঙ্গীর আলম (উপস্থিত), হাফেজ মাওলানা আবু তাহের (উপস্থিত), হোসাইন আহমেদ তামিম (উপস্থিত), মাইন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মাইন ওরফে খাজা ওরফে আবু জানদাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ (উপস্থিত), রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ (উপস্থিত), মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন (উপস্থিত), সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু (উপস্থিত), ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী (উপস্থিত) এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তখনকার মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (উপস্থিত), হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ হানিফ (পলাতক)। আদালত এঁদের সবাইকে এক লাখ টাকা জরিমানাও করেন।
এরপর বিচারক যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিচারক বলেন, ‘অভিন্ন অভিপ্রায়ে পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর জখম করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০৭/১২০-এর (খ)/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করা হলো।’
১৯ যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামি হলেন—তারেক রহমান (পলাতক), কুমিল্লার সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল (উপস্থিত), মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর আবু হোমায়রা ওরফে পীর সাহেব (উপস্থিত), মাওলানা সাব্বির আহমেদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির (উপস্থিত), আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক (উপস্থিত), হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া (উপস্থিত), ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ (উপস্থিত), আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার (উপস্থিত), আনিসুল মোর্সালীন (পলাতক), মুহিবুল মুক্তাকীন (পলাতক), খলিলুর রহমান খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), বাবু ওরফে রাতুল বাবু (পলাতক), শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আবদুল হাই (পলাতক)। আদালত এঁদের সবাইকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন।
এরপর বাকি ১১ আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ঘোষণা করেন বিচারক। তিনি বলেন, ‘দণ্ডবিধির ২১৭ ধারায় দুই বছর এবং ২১৮ ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো। পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক (আইজিপি) খোদা বক্স চৌধুরী (উপস্থিত), সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন (উপস্থিত), এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ (উপস্থিত) ও এএসপি (অব.) মুন্সি আতিকুর রহমানকে (উপস্থিত) তিন বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।’
এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক (উপস্থিত), আইজিপি আশরাফুল হুদা (উপস্থিত), আইজিপি শহুদুল হক (উপস্থিত), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন (আমেরিকায় পলাতক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার (পলাতক), ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান (পলাতক) ও ডিএমপির উপকমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসানকে (পলাতক) দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাঁদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এই মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর হওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বাকি ৪৯ জনের বিচারের রায় হয় আজ। আসামিদের মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ আসামি পলাতক। বাকি ৩১ জনের সবাই আজ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণের দিন থেকে দণ্ডাদেশ কার্যকর হবে। অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা রায়ের দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন। এ মামলার জব্দকৃত আলামত পরবর্তী সময়ের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সংরক্ষণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে দলটির সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২৪ জন নিহত ও নেতাকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান।
তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তাঁর শ্রবণশক্তিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।