হাসপাতাল ত্যাগ করতে বাধ্য, গাছের নিচে সন্তান প্রসব!
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ রীনা বেগম (৩০) নামের এক প্রসূতিকে পুরো চিকিৎসা না দিয়েই ছাড়পত্র দিয়ে অন্য হাসপাতালে যেতে বলে। এরপর হাসপাতাল চত্বরের একটি গাছের নিচে যেতেই পুনরায় প্রসব বেদনা শুরু হয় রীনার। গাছের নিচে বসে পড়লে সেখানেই তাঁর ছেলে সন্তান জন্ম নেয়।
শনিবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাল হলে উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের টনক নড়ে।
এ ঘটনায় উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযুক্ত মিডওয়াইফ নার্স শাবানা বেগমকে প্রত্যাহার করে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে শোকজের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে গত শনিবার রাতেই ওই প্রসূতি সন্তানসহ বাসায় গেছেন। বর্তমানে ওই মা ও তাঁর সন্তান নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে। দুজনেই ভালো আছে। রীনা বেগমের এটি তৃতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়েছিল। দ্বিতীয় সন্তান স্বাভাবিকভাবে হয়েছিল।
রীনা বেগম ও তাঁর স্বামী জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শুক্রবার রাতে বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের বালাভিড় গ্রামের জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী রীনা বেগমের প্রসব বেদনা ওঠে। শনিবার সকালে রীনাকে বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। প্রথম সন্তান অস্ত্রোপচার (সিজার) করে হওয়ার কথা শুনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রীনাকে ছাড়পত্র দিয়ে পঞ্চগড় অথবা ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেয়।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাছের নিচে শনিবার সন্তান প্রসবের পর হাসপাতালে রীনা বেগম। ছবি : এনটিভি
ছাড়পত্র দেওয়ার পর হাসপাতালের মিডওয়াইফ নার্স শাবানা তাদের বারবার চলে যেতে চাপ দেন। জাহিদুল ইসলাম অর্থ ও গাড়ি সংগ্রহে বাইরে থাকায় তাঁরা এক ঘণ্টা সময় চান। কিন্তু একবার নয় দুবার নয় চার চার বার তাদের হাসপাতাল থেকে চলে যেতে বলেন ওই নার্স। একাধিকবার চাপ দেওয়ায় বিরক্ত হয়ে ওই গৃহবধূর ননদ রেজিনা আক্তার তাঁকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসেন। এ সময় তাঁরা ব্যাগ-বস্তা নিয়ে হাসপাতাল চত্বরের ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে এলে পুনরায় ওই গৃহবধূ প্রসব ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। এ সময় রেজিনা তাঁকে ওই গাছের নিচে বসিয়ে দিলে সেখানেই একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। বিষয়টি দেখতে পেয়ে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নকর্মী সোহাগী এসে বাচ্চার নাড়ি কেটে প্রসূতি ও বাচ্চাকে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যান। ততক্ষণে বিষয়টি স্থানীয়রা ছবি তুলে ও ভিডিও করে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে বিষয়টি ভাইরাল ও টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়।
এ ঘটনায় রোগীর লোকজন ও স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় সাংবাদিক, ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আফরোজা বেগম রীনা ও বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ মাহমুদ হাসানসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। ইউএনও বিষয়টি শুনে তাৎক্ষণিক ওই রোগীকে দুই হাজার টাকা অর্থ সহায়তা দেন। ওই প্রসূতির পরিবারসহ স্থানীয়রা দোষীদের বিচার দাবি করেছে।
প্রসূতি রীনা বেগম বলেন, ‘ছাড়পত্র দেওয়ার পর আমি আমার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু নার্স শাবানা আমাকে ও আমার ননদকে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেন। নিরুপায় হয়ে আমি আমার ননদ রেজিনা আক্তারকে নিয়ে হাসপাতালে বাইরের একটি গাছের নিচে আশ্রয় নিই। সেখানেই আমার সন্তান প্রসব হয়।’
রীনা বেগমের স্বামী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ছাড়পত্র দেওয়ার কথা শুনে আমি টাকা ও গাড়ি জোগাড় করতে বাজারে ছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে তাদের হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া ঠিক হয়নি। আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা অমানবিক।’ ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান জাহিদুল ইসলাম।
অভিযোগ অস্বীকার করে নার্স শাবানা বেগম বলেন, রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে আমি তাদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি মাত্র।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাছের নিচে সন্তান প্রসবের পর রোববার গ্রামের বাড়িতে সন্তানসহ রীনা বেগম। ছবি : এনটিভি
বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস আই এম রাজিউল করিম রাজু জানান, ওই মিডওয়াইফ নার্স শাবানা বেগমকে প্রত্যাহার করে শোকজ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার কারণ জানতে বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. জাহিদ হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরএমও জাহিদ হাসান বলেন, তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। তদন্তের পর দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয়সহ প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউএনও সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, ‘বিষয়টি জানতে পেরে আমি তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ওই রোগীকে দেখতে যাই। আমি বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে অবহিত করি।’
বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হারুন অর রশীদ জানান, নির্মম ও অমানবিক এ ঘটনার দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন বলেন, তদন্ত কমিটির তদন্তে হাসপাতালের কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।