আপিলের শুনানি, একদিকে কান্না, একদিকে হাসি
শীতের সকালে রোদ ওঠার আগে থেকেই জতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া প্রার্থীরা একে একে জড়ো হতে থাকেন আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সামনে। হাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। সঙ্গে দলীয় সমর্থক আর বন্ধুরা। কেউ একা নন। প্রায় সবাই রাজনীতির মানুষ। ভয়-ডর, মামলা-হামলা, জেল-জুলুম উপেক্ষা করেই টিকে আছেন রাজনীতির মাঠে।
তবু আজ কেন জানি দুরু দুরু বুক, কী জানি হয়! এত দিন ধরে নির্বাচনের মাঠ গুছিয়েছেন, মানুষের কাছে গিয়েছেন, দোয়া চেয়েছেন; কিন্তু শেষবেলায় এসে যদি সেই নির্বাচনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না পান, তাহলে সেই কষ্ট কোথায় রাখবেন।
সমর্থক-বন্ধুদের বাইরে রেখে প্রার্থীরা সকাল ৯টার দিকে প্রবেশ করেন নির্বাচন ভবনে। সেখানকার দশম তলায় বসেছে আপিল শুনানির এজলাস। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে আপিল শুনানি শুরু করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) নেতৃত্বাধীন ইসি। ১০ জন করে ডাকা হচ্ছে।
নাম ডাকার পরই প্রার্থীরা লাল কাপড়ে মোড়ানো এজলাসের পাশে রাখা মাইকে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। নিজের যুক্তি তুলে ধরছেন কমিশনের সামনে। কমিশন শুনানি শেষে সঙ্গে সঙ্গে ফলাফল দিয়ে দিচ্ছে। ফলাফল পেয়ে কেউ হাসিমুখে সেখান থেকে ফিরছেন, আর কেউবা মন খারাপ নিয়ে বের হয়ে দূরে গিয়ে চোখের পানি ফেলছেন।
গত তিন দিনে ৫৪৩ জন আপিল করেছেন। প্রথম দিনে ৮৪, দ্বিতীয় দিনে ২৩৭ ও তৃতীয় দিনে ২২২টি আবেদন নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা পড়ে। আজ ১ থেকে ১৬০ পর্যন্ত ক্রমিক নম্বরের আবেদন শুনানি হচ্ছে। আগামীকাল শুক্রবার ১৬১ থেকে ৩১০ পর্যন্ত এবং শনিবার ৩১১ ক্রমিক নম্বর থেকে ৫৪৩ পর্যন্ত আবেদনের আপিল শুনানি গ্রহণ করবে কমিশন।
প্রতিটি আবেদনের আপিল শুনানি শেষে সঙ্গে সঙ্গেই রায় জানিয়ে দেওয়া হবে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি উচ্চ আদালতে কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে চান, তাহলে তাঁকে রায়ের নকল কপি দিয়ে দেওয়া হবে। বিচারকদের মুখপাত্র হিসেবে উপস্থিত আছেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
যেসব মনোনয়নপ্রত্যাশী আইন সম্পর্কে খুব ভালো জানেন না বা বোঝেন না তাঁরা আইনজীবী নিয়োগ করেছেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলার জন্য। তবে প্রয়োজনবোধে আইনজীবীর পাশাপাশি প্রার্থীও কথা বলছেন। যিনি কথা বলায় পারদর্শী, তিনি নিজে একাই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। সকাল থেকে এভাবেই চলছে যুক্তিতর্ক, চলছে পাল্টাপাল্টি কথা। হুবহু আদালতের এজলাসের মতোই।
খুলনা বিভাগের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁর ১০ জন সমর্থকের স্বাক্ষরের গরমিল পেয়ে তাঁকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। তিনি শুনানিতে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করলে কমিশন তা নামঞ্জুর ঘোষণা করেন। অনেকভাবেই তিনি অনুনয়-বিনয় করেছিলেন। কিন্তু তা কমিশনের মনকে নাড়াতে পারেনি। কারণ তিনি সব কাজ সঠিকভাবে করেননি।
এজলাস থেকে বের হয়েই সেই স্বতন্ত্র প্রার্থী নিচে নেমে গেলেন। নিচে নেমে গেটের বাইরে যেতেই আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। একজনকে জড়িয়ে ধরে উচ্চ স্বরে কেঁদে দিলেন। এই দৃশ্য দেখে যখন দু-চারজন জড়ো হতে লাগলেন তখন পরিস্থিতি বুঝে গাড়িতে উঠে কমিশন ত্যাগ করেন তিনি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে তিনি নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।
শুনানি শুরু হওয়ার কিছু সময় পরেই পটুয়াখালী-৩ আসনের গোলাম মাওলা রনি প্রার্থিতা ফিরে পেলেন। কমিশনারদের অনুমতিতে ইসি সচিব যখন তাঁর প্রার্থিতা বৈধ বলে ঘোষণা করলেন তখন তিনি মুখভরা হাসি দিয়ে এজলাস ত্যাগ করলেন। জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এত ভালো লাগছে যে আপনাকে বোঝানো যাবে না। আমি আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হব বলে আশা প্রকাশ করি। একই সঙ্গে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে বলেও আমার বিশ্বাস।’
শুনানিতে দুই মিনিট, তিন মিনিট কারো ক্ষেত্রে একটু বেশি সময় লাগছে। ১০ মিনিটের বেশি সময় ধরে কারো শুনানি করতে দেখা যায়নি। অবৈধ ঘোষিত মনোনয়নপত্র থেকে বৈধ ঘোষণা করা হলে ফেটে পড়ছেন আনন্দে। একই সঙ্গে অবৈধ থেকে গেলে মন খারাপ করে আপিলকারীরা এজলাস ত্যাগ করছেন।