নোয়াখালী-২ : দুর্গ দখলে মরিয়া বিএনপি, ধরে রাখতে চায় আ. লীগ
বিএনপির দুর্গ হিসেবে খ্যাত নোয়াখালী-২ (সেনবাগ-সোনাইমুড়ীর একাংশ) আসন। এখানে আওয়ামী লীগ ১৯৭৩ ও ২০১৪ সাল ছাড়া আর কোনোবার জয়ী হতে পারেনি। তবে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় দুটি দলের কেউই এবার ছাড় দিতে রাজি নয়। ভালো প্রার্থী হলে এ আসনে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারণায় নেমেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিএনপি থেকে ধারাবাহিকভাবে জয়ী হয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের পর দ্বিতীয়বারের মতো হাতছাড়া হয় আসনটি।
এবার বিএনপি থেকে মনোনয়ন কিনেছেন জয়নুল আবদিন ফারুক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সেনবাগ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মফিজুর রহমান।
এ বিষয়ে এনটিভি অনলাইনকে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসনে ১৯৯১ সাল থেকে মানুষ আমাকে নির্বাচিত করে আসছে। এবারও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।’
তবে বিএনপির অপর প্রার্থী কাজী মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় এলাকার জন্য কাজ করেছি। আশা করি, এলাকাবাসী সৎমানুষ হিসেবে আমাকে মূল্যায়ন করবে। আমি মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী।’
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম উঠিয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য আলহাজ মোরশেদ আলম, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহম্মেদ, আওয়ামী লীগ নেতা লায়ন জাহাঙ্গীর আলম মানিক, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জাফর আহম্মদ চৌধুরী।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টি থেকে দলের সেনবাগ উপজেলা সভাপতি হাসান মঞ্জুরের নাম শোনা যাচ্ছে। জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম জুয়েলও নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন বলে জানা গেছে।
সেনবাগ উপজেলার নয়টি ও সোনাইমুড়ী উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন মোট ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে নোয়াখালী-২ আসন গঠিত। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৭৫ হাজার ৮১ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ১০৩টি এবং বুথের সংখ্যা ৫৩৮টি।
সূত্র জানায়, এ আসনে আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। ২০১৪ সালে মূল সেনবাগ উপজেলা থেকে কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে পাশের সোনাইমুড়ীর তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে নাটেশ্বর গ্রামের মোরশেদ আলমকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। পরে তিনি সংসদ সদস্য হলে সেখানে অন্য নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ থেকে কোন্দলের সূত্রপাত হয়। তা ছাড়া বিগত পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে বঞ্চিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয় এবং কোন্দলের সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়া দীর্ঘদিনেও সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় না। হঠাৎ সম্মেলন ছাড়াই জেলা থেকে কমিটি ঘোষণা করা হয়। তাতেও মূল সেনবাগের বাইরের গ্রামের মোরশেদ আলমকে সভাপতি ও আতাউর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
অন্যদিকে সেনবাগ বিএনপির রাজনীতিকে জয়নুল আবদিন ফারুক তাঁর ঘরের মধ্যে নিয়ে গেছেন। মেয়েকে উপজেলা বিএনপির সভাপতি বানানো, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে বর্তমান সাংসদ মোরশেদ আলম ১৯৯৬ সালে বেগমগঞ্জ থেকে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করে নোয়াখালী-২ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন। পরে দলীয় নেতাকর্মীরা আশা করেছিলেন, তিনি দলকে সংগঠিত করবেন। ১৯৭৩ সালের পর দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ এ আসনে জিততে না পারায় এলাকাটিতে আওয়ামী লীগের শক্ত কোনো ভিত্তি ছিল না। দীর্ঘদিনের বিরতি কাটিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হয়েও মোরশেদ আলম সাংগঠনিকভাবে দলকে না গুছিয়ে তিনি কিছু অসাংগঠনিক ব্যক্তির বলয়ে আবদ্ধ হয়ে যান। পুরো নির্বাচনী এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মোরশেদ আলমের দূরত্ব বেড়ে যায়। তাঁর উপস্থিতিতে কোনো সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলে দলীয় নেতাকর্মীদের কম উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে তিনি শিল্পপতি হওয়ায় নিজের ব্যক্তিগত ও সরকারের দেওয়া তহবিল দিয়ে এলাকায় নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন।
অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ড. জামাল আহমেদ ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করে পরাজিত হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পেয়েছিলেন ৬৮ হাজার ২১১ ভোট। আর জয়নুল আবদিন ফারুক ধানের শীষে ভোট পেয়েছিলেন ৮৭ হাজার ৪৪৩টি।
স্থানীয়রা জানায়, নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরও এলাকা ছাড়েননি ড. জামাল। তিনি নানাভাবে এলাকার মানুষের পাশে থেকেছেন। বিশেষ করে তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর দেওয়াসহ মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। অনেকটা পরিচ্ছন্ন ও মেধাবী রাজনীতিক হিসেবে এলাকায় সুপরিচিত এই অর্থনীতিবিদ।
ড. জামাল আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মনোনয়ন পেলে দলীয় ভোটের পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের ৯০ ভাগ ভোট আমি পাব। জয়ের বিষয়ে আমি আশাবাদী। আমি নিজেকে সর্বদলীয় প্রার্থী হিসেবে মনে করি। এ আসনে এর আগে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। এখন আওয়ামী লীগ এ আসনে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। গত ২২ বছর ধরে কাজ করছি। দলীয় নমিনেশন পাওয়ার বিষয়েও আমি আশাবাদী।’
আওয়ামী লীগ থেকে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের জেলা সহসভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক। তিনি প্রতি সপ্তাহে এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সভা-সমাবেশ করেছেন।
নৌকা প্রতীকের অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন আলহাজ জাফর আহাম্মেদ চৌধুরী। তিনি ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাঁর দলের প্রার্থী মওদুদ আহমদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। সেই নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিএনপির প্রার্থী জয়নুল আবদিন ফারুক। এতে মওদুদ আহমদের সঙ্গে জাফর চৌধুরীর বিরোধ দেখা দিলে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে তিনি সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি নোয়াখালী-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
এদিকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক লায়ন জাহাঙ্গীর আলম মানিক দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। তিনি এলাকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুদান দেওয়াসহ নানাবিধ সামাজিক কাজে জড়িত রয়েছেন। আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে তিনিও মনোনয়ন কিনেছেন।