সাংবাদিকতা ছেড়ে মডেল খামারি
নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের ছেলে নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার রূপগ্রাম এলাকার সোহেল রানা (৩৫)। ছোটবেলা থেকেই ফলের বাগান করার স্বপ্ন দেখতেন। ভাবতেন, নানা জাতের গাছ থাকবে তাঁর বাগানে। বিচিত্র সব ফলে ভরে উঠবে সেই বাগান।
কিন্তু, বড় ছেলে হিসেবে ছাত্র অবস্থাতেই পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে সোহেলের ওপর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে পড়াশোনা করা অবস্থায় ক্যাম্পাস প্রতিনিধি হিসেবে দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ শুরু করেন তিনি। স্নাতকোত্তর শেষে সেখানেই ফিচার বিভাগের তথ্যপ্রযুক্তি পাতায় কাজ শুরু করেন। বেশ কয়েকটি ম্যাগাজিনেও কাজ করেন।
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার রূপগ্রামে নিজের সমন্বিত কৃষি খামারে সোহেল রানা। ছবি : এনটিভি
কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁড়িয়ে বেড়াচ্ছিল সেই বাগান করার স্বপ্ন। সোহেল পত্র-পত্রিকায় দেশের বিভিন্ন স্থানের সফল খামারিদের গল্প আগ্রহ নিয়ে পড়তেন এবং সুযোগ পেলেই সেসব খামার পরিদর্শনে যেতেন। ২০১৫ সালের কথা। একদিন সাহস করে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। বাড়িতে এসে স্বজনদের জানান নিজের স্বপ্নের কথা।
প্রথমদিকে, সবাই বাধা দিলেও শেষে পারিবারিক সহায়তায় ছোট ভাই আব্দুল বারীকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন স্বপ্নের সমন্বিত কৃষি খামার। তাঁর খামারের নাম ‘রূপগ্রাম অ্যাগ্রো ফার্ম’।
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার রূপগ্রামে নিজের সমন্বিত কৃষি খামারে সোহেল রানা। ছবি : ফেসবুক থেকে নেওয়া
সোহেল রানার সমন্বিত কৃষি খামার এখন এলাকার শিক্ষিত বেকারদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর বাগান দেখে এখন অনেকেই মিশ্র ফলের বাগান করছেন। রূপগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে শতাধিক ফলের বাগান। এসব বাগানে আম, পেয়ারা, লেবু, স্ট্রবেরি ও কুল গাছই বেশি।
বাড়ির পাশের ১৮ বিঘা জমিতে সোহেল রানার বাগানটি গড়ে উঠেছে। তাঁর খামারে রয়েছে আম, লিচু, ড্রাগন ফল, মাল্টা, খাটো জাতের নারিকেল, লেবুসহ ৫০ প্রজাতির ফলের গাছ। খামারে আরো আছে বাসক, তুলসী, নিম, নীল অপরাজিতা, সাদা লজ্জাবতীসহ নানা প্রজাতির ঔষধি গাছ। আছে বিভিন্ন জাতের ফুল গাছও। এ ছাড়া তিনটি পুকুরে মাছ চাষ করছেন সোহেল রানা। করছেন হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালনও। সমন্বিত খামারের পাশে ১০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন আমের বাগান। পাশের সাপাহার উপজেলার মানিকুড়া গ্রামে পাঁচ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে চাষ করছেন থাই পেয়ারা। এসব খামার থেকে বছরে আয় করছেন কয়েক লাখ টাকা।
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার রূপগ্রামে নিজের সমন্বিত কৃষি খামারে সোহেল রানা। ছবি : ফেসবুক থেকে নেওয়া
এ ছাড়া সোহেল রানা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) থেকে কৃষির ওপর বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ছাড়া যেকোনো পরামর্শের জন্য ছুটে যান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের কাছে। তাঁরাও বেশ যত্ন সহকারে তাঁকে সাহায্য করেন।
সাপাহারের নিশ্চিন্তপুরের শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সোহেলের খামার দেখে উৎসাহিত হয়ে ১০ বিঘা জমিতে আম ও থাই পেয়ারার বাগান করেছি। এ ছাড়া দুটি পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ করছি। বাগান ও মাছ চাষ করার ব্যাপারে সোহেল রানা বিভিন্ন সময় চারা ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন।’
করমজাই গ্রামের আবদুল জব্বার বলেন, ‘সোহেলের সাফল্য দেখে উৎসাহিত হয়ে চার একর জমিতে গত বছর আম ও পেয়ারার বাগান গড়ে তুলেছি। আশা করছি, সফল হব।’
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার রূপগ্রামে নিজের সমন্বিত কৃষি খামারে সোহেল রানা। ছবি : ফেসবুক থেকে নেওয়া
নিজের স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘এই এলাকায় অ্যাগ্রো ট্যুরিজম গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে আমার। যেখানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ফল থাকবে। এ ছাড়া বিলীন হতে বসা বিভিন্ন দেশি গাছের (জার্ম প্লাজম) সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে। এ লক্ষ্যে রূপগ্রাম অ্যাগ্রো ফার্মের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ছোট ভাই আব্দুল বারী ও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে সাপাহার উপজেলায় প্রায় ৫৫ বিঘা জমি ১৫ বছরের জন্য ইজারা নিয়ে ‘‘বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্ক’’ নামে আধুনিক সমন্বিত খামারের কাজ শুরু করেছি।’
গত ২৭ অক্টোবর খামারের পুকুরে ছাড়েন ৪১ কেজি শিং মাছের পোনা। ছবি : ফেসবুক থেকে নেওয়া
পত্নীতলা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা প্রকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘উচ্চশিক্ষত হয়ে শুধু চাকরি করতে হবে এই কথা ঠিক না। বরং লেখাপড়া জানা মানুষদেরই কৃষি পেশায় আশা উচিত। চাকরি করে শুধু নিজের পরিবার চালানো সম্ভব। কিন্তু একজন ভালো উদ্যোক্তা কিংবা সফল খামারি নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন। সোহেল রানা সেটিরই উজ্জ্বল উদাহারণ।’
সোহেল রানা জানান, কৃষি বিভাগ তাঁর খামারকে সফল করার জন্য চারা দিয়ে পরামর্শ দিয়ে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে আসছে। বর্তমানে সোহেল একজন মডেল খামারি।