‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আর কোনো সংঘাত নয়’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে সেখানে শান্তি বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে ভূমি বিরোধ নিরসনে ভূমি কমিশনের কাজে সহযোগিতা করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা পার্বত্য চট্টগামে আর কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতি চাই না। আমরা চাই এ অঞ্চলের জনগণ যেন ভালো থাকে এবং এখানে শান্তি বজায় থাকে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর বেইলী রোডে তাঁর নামে নির্মিত ‘শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স’-এর উদ্বোধন করার সময় এসব কথা বলেন।
সরকার প্রধান বলেন, ‘একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ না থাকলে কিন্তু উন্নয়ন করা যায় না। এ কথাটা মনে রাখতে হবে। আজকে সারা বাংলাদেশে যে আর্থসমাজিক উন্নয়ন হচ্ছে তার কারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। এটা বজায় থাকলেই উন্নয়নটা ত্বরান্বিত করা যায়।’ তিনি বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ এই ধরনের উন্নয়নের মাধ্যমেই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারব।’
এরইমধ্যে তাঁর সরকার পার্বত্য এলাকায় এক হাজার ৬৫৯ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ দিচ্ছি, যেখানে বিদ্যুতের গ্রিড লাইন নাই সেখানে সোলার প্যানেল করে দিচ্ছি যাতে কোন ঘর অন্ধকারে না থাকে। সব ঘরে যেন আলো জ্বলে।’
সবাই যেন ভারো থাকেন সেই আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আর কোনো সংঘাত নয়, সবাই যেন ভালো থাকেন। যে শান্তিচুক্তি আমরা করেছি সেই শান্তি যেন পাহাড়ে বজায় থাকে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শান্তির মধ্যদিয়েই সমৃদ্ধি অর্জন করা যায়। শান্তির পথ ধরেই আসবে প্রগতি। আর প্রগতিই নিয়ে আসবে সমৃদ্ধি। আর এই সমৃদ্ধির পথ ধরেই আমরা জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে যা যা করণীয় আমরা তার সবই করেছি। ভূমি নিয়ে যে সমস্যা তার জন্য ভূমি কমিশন করে দিয়েছি। সাধারণ ভূমি অধিগ্রহণ করতে গেলে যে সমস্যাটা হয় অন্যান্য জায়গায় যেভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেভাবে হয় না। তার কারণ মালিকানাটা নিয়ে একটা সমস্যা।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমি বলব, ব্রিটিশ আমলে কী আইন করে গেছে সেটাকে অনুসরণ না করে আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ তার নিজের ভূমির মালিকানা নিজের নামে যদি পায় তাহলে এই যে সমস্যা-তারা যে ক্ষতিপূরটা পাচ্ছে না, তা তারা পেতে পারেন। কাজেই ভূমি কমিশনকে সহযোগিতা করে তাদের এই ভূমি সমস্যাটির যথাযথ সমাধান যাতে করা যায়, তার জন্য আমি সহযোগিতা চাচ্ছি। কারণ এখানে যতবার কমিশন কাজ করতে গেছে তারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চাকরি-বাকরির সব ক্ষেত্রে আমরা যদিও কোটা প্রত্যাহার করেছি তারপরও আমার নির্দেশ আছে পিএসসিকে বলে দিয়েছি পার্বত্য অঞ্চল বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যে প্রার্থী থাকবে তারা সবসময় অগ্রাধিকার পাবে। এটা আমাদের সরকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে এবং করে দেবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ৯৬ সালে সরকার গঠন করে ৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করি এবং এর পরবর্তী মেয়াদে আমরা ক্ষমতায় ছিলাম না তাই আমাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই আবার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রায় ২০টা বছর পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ অবহেলিত ছিল। সেখানে যাতায়াত করা যেত না। আমি যখনই সেখানে গেছি বলা হয়েছে ৩টার মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শান্তিচুক্তির পরে আর সেই অবস্থাটা নেই। কিন্তু এই ২০ বছরের যে উন্নয়ন হয়নি, ২০ বছরের যে বঞ্চনা সেটা পুরণ করবার জন্যই আমরা বিশেষভাবে বরাদ্দ দিয়ে দিয়ে রাস্তা, ঘাট, পুল- ব্রিজ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে নির্মাণ করে দিচ্ছি। সেইসাথে আবাসিক স্কুল পর্যন্ত করে দিচ্ছি যাতে করে সেই দুর্গম পাহাড় বেয়ে ছেলেমেয়েদের আসতে কষ্ট না হয় এবং সেখানকার মানুষ আরো কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। এজন্য আমাদের সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের যেমন প্রকল্প রয়েছে, সেই সাথে তারা স্থানীয়ভাবেও কাজ করে যাচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই ক্ষেত্রেও এখানে যে আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ রয়েছে, তাদেরও বলব নিজ নিজ অঞ্চলে সার্বিক উন্নয়নে কী কী করণীয় তার জন্য আপনারা নিজেরাও প্রকল্প তৈরি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনারাও প্রস্তাব আনতে পারেন, যা আমরা বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে বাস্তবায়ন করে দিতে পারব। যাতে কোনোমতেই আর কেউ পিছিয়ে না থাকে।’
প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভবন নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই প্রকল্পটা করে দিয়েছি কারণ এই জায়গাটা আমি নিজেই পছন্দ করেছিলাম। তিনি বেইলি রোড এলাকায় শৈশবে বসবাসের স্মৃতি রোমন্থনে বলেন, ছোটবেলায় এই জায়গাটায় অনেক এসেছি অনেক খেলাধুলা করেছি কাজেই এই জায়গাটা আমি চিনি।’
জায়গাটি নেওয়ার জন্য অফিসার্স ক্লাব খুব চেষ্টা করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এজন্য তারা মামলা পর্যন্ত করেছিল। সেই মামলা ঠেকিয়ে দিয়ে আমরা জায়গাটি পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর জন্য নিয়েছি।’
রাজধানীর মধ্যে এক টুকরো পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ডিজাইনটা করার সময়ই আমি বলেছি এটা এমনভাবে তৈরি করতে হবে- এই জায়গায় কেউ এসে দাঁড়ালে তারা যেন মনে করতে পারে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামেই এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব থাকবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকজন যারা আসবেন তাঁদের ঢাকায় অবস্থান, বিভিন্ন কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য সব সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করা, ডরমেটরির ব্যবস্থা- সবকিছু সুন্দরভাবে করে দেওয়া হয়েছে।’
গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উসে সিংহ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব নুরুল আমিন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন অগ্রগতির ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।