মাহবুব তালুকদারের প্রস্তাব সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক : কবিতা খানম
‘নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে নিয়ে আসা’ নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন আরেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম।
আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এই কথা বলেন কবিতা খানম।
কবিতা খানম বলেন, ‘নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে নিয়ে আসা’ এটা কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ৫৫ (২) বলা হয়েছে, এটি নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে। এই দুটোর দায়িত্ব কিন্তু সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ন্যস্ত। সুতরাং এটা নির্বাচন কমিশনে নিয়ে আসা নিয়ে আলোচনা করা মানেই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।’
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর একটি আন-অফিসিয়াল (ইউও) নোট দিয়ে তাঁর কিছু প্রস্তাবনা কমিশন সভায় উত্থাপন করার জন্য জানান। সেই ইউও নোট পেয়ে সিইসি প্রস্তাবনাগুলো কমিশন সভার উত্থাপন করতে অনুমতি দিয়ে একটি চিঠি দেন মাহবুব তালুকদারকে। অথচ কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম, শাহাদাত হোসেন ও মো. রফিকুল ইসলাম আলাদা আলাদা ইউও নোট দেন সিইসিকে। ইউও নোট দেওয়ার কারণ, যাতে মাহবুব তালুকদারকে তাঁর প্রস্তাবনাগুলো কমিশন সভায় উপস্থাপন করতে না দেওয়া হয়। তিন নির্বাচন কমিশনারের ইউও নোটের বিষয়টি মাহবুব তালুকদার জানতে পারেন। এবং তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁকে প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপন করতে দেওয়া হবে না। এরপর বাকস্বাধীনতা হরণের অভিযোগ তুলে তিনি ১৫ অক্টোবরের ৩৬তম কমিশন সভায় নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সভা বর্জন করেন।
কমিশনার মাহবুব তালুকদারের দেওয়া ওই প্রস্তাবনার ‘নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি’ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে তিনি বলেছিলেন, ‘সংলাপের সুপারিশে অংশীজনের অনেকে নির্বাচনকালে সার্বিকভাবে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করতে বলেছেন। কেউ কেউ অর্থ, তথ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কেও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনার সুপারিশ করেছেন। বিষয়টি বিতর্কমূলক সন্দেহ নেই। তবে আমার মনে হয় বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের কাছে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পিত হলে নির্বাচনে জনগণের আস্থা বেড়ে যাবে এবং নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে তা সহায়ক হবে।’
এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম আজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এছাড়াও সেনা মোতায়েন বিষয়ে যে প্রস্তাবটি ছিল সেটা নিয়ে কিন্তু এখনো আলোচনার সময় আসেনি। সরকারের সঙ্গে সংলাপ নিয়ে আরেকটি একটি প্রস্তাব ছিলো। সরকারের সঙ্গে আমরা কী সংলাপ করব? এই মুহূর্তে তো সংলাপ করার কিছুই দেখি না।’
কবিতা খানম বলেন, ‘নোট অব ডিসেন্ট হয় কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেদিন কমিশনের সভায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় ছিল না। সুতরাং সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।’
কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ‘মাহবুব তালুকদার কমিশনের সভা বর্জন ও তাঁর নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেছেন। সেটি বাইরে প্রচার হয়েছে। বাইরে থেকে শুনছি, কমিশনে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। কিন্তু আমরা তা ফিল করছি না। কমিশনে পাঁচজন কমিশনার আছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে। কারও ভিন্ন মত থাকতে পারে। সেটাকে কমিশনারদের বিরোধ বলা যাবে না।’
সংসদ বহাল রেখে যেহেতু নির্বাচন হবে সেহেতু বিদ্যমান আচরণবিধিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনারা- এমন প্রশ্নে কবিতা খানম বলেন, ‘বড় ধরনের পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। আচরণবিধিতে পরিবর্তন না আনলেও নির্বাচনে কোনো সমস্যা হবে না। তবে, আইন সংস্কার কমিটি থেকে সাধারণ কিছু সংশোধনের প্রস্তাব প্রস্তুত করেছে। এতে প্রতীক হিসেবে জীবন্ত প্রাণী ব্যবহার না করা, ডিজিটাল ডিসপ্লের মাধ্যমে প্রচারণার সুযোগ না থাকাসহ কিছু বিষয় আছে। তবে, এইগুলো না হলেও বিদ্যমান আচরণবিধিতে নির্বাচন সম্ভব।’
প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপিদের প্রচারণার বিষয়ে কবিতা খানম বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সরকারি সুবিধা ব্যবহার করে প্রচারণার না করার বিষয়টি বিদ্যমান আচরণ বিধিতেই আছে। কাজেই এই ক্ষেত্রে বিধিমালা সংশোধনের কোনো দরকার পড়বে না। আইন সংস্কার কমিটিও এই ক্ষেত্রে কাজ করার দরকার মনে করছে না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সংজ্ঞায়, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ ও তাদের সমমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, সংসদ সদস্য ও সিটি মেয়র রয়েছেন। কোনো ধরনের সরকারি সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবে না।’
জাতির পিতার কন্যা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নিরাপত্তার বিষয়টি ইঙ্গিত করলে কবিতা খানম বলেন, ‘আইন যদি কাউকে পারমিট করে, সেটা তো তিনি করতেই পারবেন। কারণ নিরাপত্তার বিষয় রয়েছে। অন্য কোনো আইনে প্রটোকলের বিষয়ে কোনো সুযোগ দিয়ে থাকলে বিধিমালায় কিছু বলা নেই। সাধারণ আইন কখনো বিশেষ আইনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করবে না। বিশেষ আইন দ্বারা কোনো সুবিধা দেওয়া থাকলে তা সেইভাবেই কার্যকর হবে। তবে, আইনের বাইরে কোনো সুবিধা পাবেন না।’