বাসক পাতায় বদলে যাচ্ছে গ্রাম
গ্রামাঞ্চলে বাসক পাতার কদর চিরায়ত। সর্দি, কাশি সারাতে এই পাতার রসের উপকারিতা সবারই জানা। কিন্তু এখন ওষুধ কোম্পানিগুলোও বাসক পাতার কদর দিতে শুরু করেছে। ফলে, এই পাতা বিক্রি করে স্বচ্ছল হয়ে উঠছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ।
আজ শনিবার সাতক্ষীরায় গিয়ে এমনটিই দেখা যায়। সাতক্ষীরায় বাসক উদ্ভিদ জন্মায় প্রচুর পরিমাণে। এসব পাতা এখন ওষুধ কোস্পানিগুলো কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এর ঔষধি-গুণ এত বেশি যে, এই পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে কাশির সিরাপ। বাসক পাতার নির্যাস, রস বা সিরাপ শ্লেষ্মা তরল করে নির্গমে সুবিধা করে। ফলে সর্দি, কাশি এবং শ্বাসনালির অসুখ সারাতে এটি বেশ উপকারী।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা মো. শামীম আলম জানান, পাউবোর প্রকল্প ব্লু গোল্ডের আওতায় ২৮৫ জন নারী ফিংড়ি ইউনিয়নে বাসক পাতা সংগ্রহের কাজ করছেন। এই পাতা কিনে নিচ্ছে কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি।
পাউবো কর্মকর্তা বলেন, ‘বাসক পাতা যেমন আনতে পারে অর্থনৈতিক বিপ্লব, তেমনি বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই পাতা দেশের ওষুধ শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারছে।’
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের প্রতিনিধি মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুকনো বাসক পাতা কিনে নিচ্ছি। জার্মান প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বাসক পাতা থেকে কাশির সিরাপ তৈরি হচ্ছে। দিন দিন এর চাহিদাও বাড়ছে।’
সাতক্ষীরার গ্রামগুলোতে এরই মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে গেছে বাসক পাতা নিয়ে। গ্রামবাসী নিজ নিজ বাড়ির চারপাশে বাসক গাছ লাগাচ্ছে। গ্রামের দরিদ্র নারীরা প্রতিদিনই সংগ্রহ করছে শত শত বাসক পাতা। পরিচ্ছন্নভাবে রোদে শুকিয়ে তা বিক্রি করছে ওষুধ কোম্পানির কাছে। এতে তারা অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে।
ফিংড়ি গ্রামের হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগে মনে করতাম আবর্জনা। এখন তা সংগ্রহ করে বিক্রি করছি। এতে লাভ হচ্ছে বেশ।’
একই গ্রামের আমিরুন বেগম জানান, তিনি প্রতি কেজি কাঁচা পাতা ৫ টাকা দরে কিনছেন। শুকিয়ে বিক্রি করছেন ৩৫ টাকায়।
বাসক পাতা সংগ্রহকারী দলের নেতা বিউটি বেগম বলেন, ‘আমরা কাঁচা পাতা রস করে খাই। আগে এর কোনো অর্থনৈতিক গুরুত্ব দিতাম না। এখন সংগ্রহ করে বিক্রি করছি। বাড়ির বেড়ার গায়ে থাকে। গাছ বাড়েও বেশ। এখন তা তুলে এনে শুকিয়ে বিক্রি করছি। এতে আমরা লাভবান হচ্ছি। বাসক লাগাতে আলাদা জমির দরকার নেই।’
ফিংড়ি ইউনিয়নের কাঁচাপাকা রাস্তার ছয় কিলোমিটার এলাকা বরাবর রয়েছে বিপুল বাসক উদ্ভিদ। এখানকার কমপক্ষে ১০ হাজার বাসক গাছ ব্যবহৃত হচ্ছে জমির চারধারে কিংবা বাড়ির চারপাশে বেড়া দেওয়ার কাজে। প্রতি বছর ১০০ টন পাতা সংগ্রহ হচ্ছে এসব গাছ থেকে। বছরে এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ২৬ টন শুকনো পাতা। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে বাসক উদ্ভিদের চাষ শুরু হয়েছে। ফলে ফিংড়ি গ্রামের বহু নারীই বাসক পাতা সংগ্রহ করে এভাবে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন।
বাসক পাতা চাষে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন- এই উদ্ভিদ দিয়ে বাড়িঘরের বেড়া দেওয়া হয়। পাতা ছিঁড়লেও গাছ মরে যায় না। আবারও নতুন পাতা গজায়। সারা বছর চলে নতুন পাতা গজানো। ডাল কেটে মাটিতে পুঁতে দিলেই জন্মায় নতুন গাছ।
এ ছাড়া বিকট গন্ধের কারণে এতে ছত্রাক জন্মায় না। এমনকি পোকামাকড়ও ধরে না। খায় না পশুপাখিও। বরং এই পাতা দিয়ে ফলমূল মুড়ে রাখলে তা ভালো থাকে।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. নাসরিন আক্তার বলেন, ‘বাসকের বৈজ্ঞানিক নাম আঢাটোডা বাসিকা। এটি ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি উদ্ভিদ। এর পাতা ও ফলে এক ধরনের দুর্গন্ধ আছে। যে কারণে তা ব্যবহার করলে ছত্রাক রোধ করা যায়। তা ছাড়া এর ঔষধিগুণ খুব বেশি। এসব গুণের কারণে বাসক বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে বাংলাদেশেও। ভারতের তামিলনাড়ুতে বাসকের ব্যাপক চাষ রয়েছে। বাসক উদ্ভিদের জন্ম ও বৃদ্ধিতে সাতক্ষীরার মাটি অনুকূল। বেশি বেশি করে বাসক গাছ লাগালে এর পাতা দেশের ওষুধ শিল্পে অবদান রাখা ছাড়াও গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে।’