‘মা বাড়ি থেইকা বার করে দিছে, আর যাইনি’
সাইফুল ইসলাম শান্ত (৯) ভ্রাম্যমাণ পথশিশু হিসেবে থাকে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে। বাবা সোহেল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় দুই বছর আগে। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার সদরের ঠাকুরপাড়া। স্কুলের পরীক্ষার ফি চাওয়ায় রাগে তাকে বাসা থেকে বের করে দেন গর্ভধারিণী সালমা বেগম।
দেড় বছর আগে সেই যে ট্রেনে চড়ে কমলাপুর চলে আসে আর কখনো বাড়ি ফিরে যায়নি শান্ত। পরিবার থেকেও কখনো কেউ খোঁজ নেয়নি। এমনকি পরিবারের কাছে ফোন দিলেও তারা শান্তর কণ্ঠ শুনে ফোনের লাইন কেটে দেয়। কুলিগিরি করে স্টেশনে ঘুমিয়েই দিনরাত কাটে ছোট্ট শিশু শান্তর।
শুক্রবার কমলাপুর রেলস্টেশনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় সাইফুল ইসলাম শান্ত এসব কথা বলে। শুধু শান্তই নয়, এমন আরো বহু ছোট্ট শান্ত আছে যারা পরিবাবের অনটন, কলহ কিংবা বিভিন্ন ঝামেলার কারণে কমলাপুরে এসে আর ফিরে যায়নি নিজ বাড়িতে। কমলাপুরকে বানিয়ে ফেলেছে স্থায়ী ঠিকানা। এদের অনেকেই কমলাপুরে এসে জড়িয়ে পড়ছে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে।
কমলাপুরে কীভাবে এলে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম শান্ত এনটিভি অনলাইনকে বলে, ‘স্কুলের পরীক্ষার ফিসের জন্য টাকা চাইছি মার কাছে। মা কয়, আমার কাছে টাকা নেই যা। ভিক্ষা করে দে, নাইলে বাড়ি থেইকা বার হয়ে যা। তারপরে মা বাড়ি থেইকা বার করে দিছে, আইয়া পড়ছি, আর যাইনি।’
শান্ত আরো বলে, ‘এরপর ট্রেনে উইঠা কমলাপুর চইলা আইছি। ট্রেন থেকে নেমে ৭ নম্বর প্লাটফর্মের এক জায়গায় বইয়া আছিলাম। ভালা লাগছিল না। তারপরে দুদিন ৭ নম্বর প্লাটফর্মেই শুইয়া-বইয়া ছিলাম। ওখানে থেকে দেখতাম ট্রেন আইলে পোলাপান বোঝা নিত, ২০ টাকা ৩০ টাকা কইরা। এর দুদিন পর থেকে আমি বোঝা টানতাম। ২০০-৩০০ করে টাকা হইতো। ওই দিয়ে অনেক কিছু কিনে খাইতাম। কিন্তু মশার কামড়ে শুইতে খুব কষ্ট হইত। কানতাম সব সময়। এক মাস ধরে একজন কমলাপুর পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমাকে রেখে আইছে। কিন্তু ভালা লাগে না। আর কয়েকদিন থেকে আর যামু না ওখানে।’
কখনো বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না-এমন প্রশ্নে শান্ত বলে, ‘বাড়িতে একবার ফোন দিছিলাম। হ্যালো শুনেই কেটে দিছিল। এরপরে বাড়ির প্রতি রুচি উইঠা গেছে গা। মা ভালা না। সারাদিন ফোনে হাইসা হাইসা সব সময় কার লগে কথা কয়। আমার তিন চাচা। দুই চাচা নেশা করে। তারা খুব মারত। আমার জীবনটা মাঝ দিয়ে শ্যাষ হয়ে গেছেগা।’
শান্তর পাশেই বসে ছিল ইয়াসিন আলী (১২)। গ্রামের বাড়ি যশোরের শঙ্করপুর। ইয়াসিনের বাবা-মা বেঁচে নেই। যশোরে থাকত খালার বাড়ি। সে এনটিভি অনলাইনকে বলে, ‘স্কুলে যেতাম না। তাই খালু খুব মারত। সারাদিন অনেক কাজ করতে হতো। কষ্ট হয়ে গেলে স্কুলে যেতাম না। অনেক মারত বলে তারপরে চুরি করে ঢাকায় চলে আসি। একজন আমাকে কমলাপুর লইয়ে আসে। তারপর থেকে এখানে খাই-দাই, ঘুমাই। বোঝা মারি আর জমিলা খালার মাল (গাঁজা) বিক্রি করি। মেলাদিন ধরে বোনের কবর দেখি না। তাই মনডা খুব খারাপ। বাড়ি যাব খানিকদিন পরে। আর আসব না। এর আগেও একবার বাড়ি গিছি কিন্তু থাকিনি।’
কমলাপুর রেলস্টেশনের আরেক পথশিশু সিফাত হোসেনের (১৫) গ্রামের বাড়ি গাজীপুর। সিফাতের বাবা তার মাকে প্রচণ্ড মারতেন। ৯ বছর আগে তার বাবা আবার বিয়ে করেন। বিয়ের পরে ছয় বছর বয়সেই ট্রেনে চড়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে আসে সিফাত। গত বছরের প্রথম দিকে সিফাত একবার গ্রামের বাড়ি গেলেও চারদিন থেকে আবার চলে আসে।
এসব বিষয়ে সিফাত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘বাড়ি থেকে চলে আসার পরে আর বাড়ি যাইনি। আর যাব না। ভালা লাগে না। তবে আম্মুর সাথে ফোনে কথা হয়।’
‘আট-নয় বছর আগে যখন কমলাপুরে আহি তখন আমার খুব খারাব (খারাপ) লাগছিল। খাবারের দিকে তাকাই থাকতাম কিন্তু কেউ খেতে দিত না। এরপরে এখানে অনেক বন্ধু হয়। ছোডো বেলা থেকে মাথায় করে মাল টানতাম। আর জমিলা খালার গাঁজা বিক্রি করে দিতাম। যা টাকা পাইতাম সব শেষ করে দিতাম। মার কথা মনে হলে গাঁজা খাইতাম। একবার জমিলা খালার বড়িসহ (ইয়াবা) পুলিশ ধরছিল। সেখান থেকে আর বড়ি বেচি না।’
পথশিশুদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভ্রাম্যমাণ পথশিশু বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত। এর বড় কারণ তদারকির অভাব। সাধারণত কিশোর বয়সের এসব শিশুরা অপরাধ জগতে প্রবেশ করে অন্য অপরাধীর হাত ধরে। তাতে আবার তারা এক ধরনের আনন্দও পায়। অনেকে আবার ওদের দিয়ে মাদক ব্যবসাও করিয়ে নেয় আজকাল। কারণ প্রশাসন সোচ্চার হওয়াতে ব্যবসায়ীরা শিশুদের বেছে নেয়। এসব পথশিশুর দিকে নজর দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র এদের দিকে নজর না দিলে এসব ছিন্নমূল পথশিশুদের পরিবেশ কখনো ভালো হবে না। আমাদেরও দায়িত্ব হচ্ছে ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার না করে বোঝানো।’
এসব ব্যাপারে কথা হলে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন মজুমদার ফারুক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এখানে প্রচুর পথশিশু আছে, যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। এদের বাড়ি যেতে বললেও যায় না। বিভিন্ন নেশায় জড়িয়ে পড়ে। আর এসব নেশায় জড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ জমিলা বেগম। জমিলা এই শিশুদের দিয়ে মাদক বিক্রি করায়। পুলিশ জমিলাকে খুঁজছে। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেছি সে নাকি ভারতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শুনেছি জমিলার ছেলে, মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনি সবাই মাদকের সঙ্গে জড়িত। যাকে যেখানে পাওয়া হবে গ্রেপ্তার করা হবে।’