পাবনায় মা-বাবাকে খুঁজছেন ডেনিশ নাগরিক

Looks like you've blocked notifications!
স্ত্রীকে নিয়ে পাবনায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন মিন্টু। ছোটবেলার ছবিটি দিয়ে লিফলেট বানিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। হারিয়ে যাওয়া মা-বাবাকে ফিরে পেতে চান তিনি। ছবি : এনটিভি

মাত্র ছয় বছর বয়সে পাবনার নগরবাড়ী ঘাটে হারিয়ে যান মিন্টু। ১৯৭৭ সালের কথা। সেখান থেকে চৌধুরী কামরুল হোসেন চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি মিন্টোকে পৌঁছে দেন ঢাকার এক আশ্রমে। ১৯৭৮ সালে ওলে ও বেনফি নামের ডেনিশ দম্পতি মিন্টোকে দত্তক নিয়ে ডেনমার্ক চলে যান।  

সেই মিন্টুর বয়স এখন ৪৭। পুরো নাম মিন্টু কার্স্টেন সনিক। ছেলেবেলার কোনো স্মৃতিই মনে নেই তাঁর। জানেন না বাংলা ভাষা। পেশায় চিত্রশিল্পী মিন্টোর গায়ের রং জানান দেয় তিনি বাঙালি।

ছোটবেলার একটা ছবি আছে মিন্টুর কাছে। সেটা নিয়েই পাবনায় ঘুরছেন তিনি। যদি কেউ চেনে!

তবে এখনো মা ও বাবার কোনো সন্ধান পাননি। আগামী তিন-চারদিনের মধ্যে মিন্টুর দেশে ফিরে যাওয়ার কথা। তবে তিনি দমে যাওয়ার লোক নন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি আবার তাঁর বাবা, মা ও পরিবারের সন্ধান করতে বাংলাদেশ আসবেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

আজ বৃহস্পতিবার মিন্টু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এখন অর্ধেক সফল। আগামীবার সম্পূর্ণ সফল হব।’

গতকাল বুধবার পাবনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন মিন্টু। সেখানে তিনি জানান, গত ৪ সেপ্টেম্বর সস্ত্রীক তিনি পাবনায় আসেন। কিছুদিন আগে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন পাবনায় স্বাধীন বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে চলে আসেন বাংলাদেশের পাবনায়।

৪১ বছর পর হারিয়ে যাওয়া মা-বাবার সন্ধানে স্ত্রীকে নিয়ে পাবনার পথে পথে ঘুরছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ডেনিশ নাগরিক মিন্টু কার্স্টেন সনিক। ছয় বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া মিন্টু জানেন না তার মা-বাবা এমনকি গ্রামের নাম। ছোটবেলার একটি ছবিকে সম্বল করে নিজের পরিবার ফিরে পেতে গত ১০ দিন ধরে পাবনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়াছেন তিনি। হারিয়ে যাওয়ার সময়কার তার ছবি দেখিয়ে জানতে চাইছেন কেউ এই ছেলেটিকে চেনেন কি না?

গত ১০ সেপ্টেম্বর পাবনা শহরের খামারবাড়ি রেস্টুরেন্টে তাঁরা নিজেদের বিয়েবার্ষিকী পালন করেন। এ সময় মিন্টু বলেন, ‘যদিও আমি আমার মা-বাবাকে পাইনি তার পরও মনে হচ্ছে নিজের ঘরের মানুষের সঙ্গে ম্যারেজ ডে পালন করছি।’

স্ত্রীকে নিয়ে পাবনায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন মিন্টু। ছোটবেলার ছবিটি দিয়ে লিফলেট বানিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। হারিয়ে যাওয়া মা-বাবাকে ফিরে পেতে চান তিনি। ছবি : এনটিভি

মিন্টু জানান, পুরোনো কাগজ ঘেঁটে জেনেছেন মাত্র ৬ বছর বয়সে পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী ঘাট এলাকা থেকে হারিয়ে যান তিনি। সেখান থেকে ঢাকার ঠাটারীবাজার টেরি ডেস হোমস নামের শিশু সদনে ছিলেন। পরে শিশু সদন থেকে ১৯৭৮ সালে ডেনমার্কের এক নিঃসন্তান দম্পতি মিন্টুকে দত্তক নিয়ে যায়। সেখানেই তাঁর শৈশব-কৈশোর কাটে। বিত্তবৈভবের মাঝে লেখাপড়া শিখে বড় হন। পেশায় একজন চিত্রশিল্পী তিনি। ডেনমার্কের নাগরিক এনিটি হোলমিহেভ নামের এক চিকিৎসককে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। ওই দম্পতির এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে।

মিন্টুর স্ত্রী এনিটি হোলমিহেভ বলেন, ‘আগে মিন্টোর তেমন সমস্যা ছিল না। বয়স বাড়ারা সঙ্গে সঙ্গে তিনি হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করেন। অবশেষে পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে ছোটবেলার একটি ছবিকে অবলম্বন করে ছুটে আসেন পাবনায়। কয়েকদিন ধরে মা-বাবা, স্বজনদের খোঁজে পাবনা শহরসহ নগরবাড়ি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন এই দম্পতি।

মিন্টু বলেন, ‘ডেনমার্কে আমার পালক পিতা-মাতা ও স্ত্রী সন্তানদের  নিয়ে খুব সুখেই আছি, তবুও আমার অন্তর এখনো বারবার কেঁদে ওঠে বাংলাদেশের মা-বাবা ও স্বজনদের জন্য। মনে হয় স্বজনদের পেলে জীবনটা সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে।’ মিন্টু আরো বলেন, ‘মা-বাবা ও স্বজনদের কথা মনে হলে আমি প্রচণ্ড শূন্যতা অনুভব করি। যদি বাবা, মায়ের খোঁজ পাই তাহলে সেটা অসাধারণ হবে। না পেলে মৃত্যুর আগে জানব তাদের খুঁজে পেতে আমি চেষ্টা করেছিলাম।’

বাংলাদেশে এসে কেমন লাগছে জানতে চাইলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডেনিশ নাগরিক মিন্টু বলেন, ‘প্রতিটি মানুষকে আমার আপন মনে হচ্ছে, আমার চেহারার সাথে তাদের মিল। যেন আমি আয়নায় নিজেকেই দেখছি।’

মিন্টুর স্ত্রী এনিটি হোলমিহেভ বলেন, ‘মিন্টোর এ দেশে কাটানো শৈশবের কোনো স্মৃতিই মনে নেই। যে আশ্রমে সে ছিল তারও অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। ছোটবেলার দুই একটি ছবি ছাড়া কোনো সূত্র নেই। জানি তার স্বজনদের খুঁজে পাওয়া এটা খুব কঠিন কাজ। এরপরও এক বুক আশা নিয়ে পাবনার পথে পথে মিন্টুর শেকড় খুঁজে বেড়াচ্ছি।

এ বিষয়ে পাবনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) শামীমা আকতার বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনেছি। পুলিশের পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতা করার আমরা করছি। ইতিমধ্যেই তিনি পাবনা সদর থানায় একটি এজহারও দায়ের করেছেন। তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আমাদের পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমগুলোরও মিন্টুর পাশে দাঁড়ানো দরকার।’ 

পাবনা ব্যাপ্টিস্ট মিশন হাউসের কর্মকর্তা স্বাধীন চার্লস বিশ্বাস মিন্টুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘পাবনার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টির দায়িত্ব নিয়েছে। তাই এবার তিনি ফিরে যাবেন। পরে আবার সময় নিয়ে আসবেন।’

পাবনার জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ডেনমার্ক নাগরিক মিন্টু কার্স্টেন সনিকের বিষয়টি স্পর্শকাতর। অনেকেই তাঁর মা-বাবার দাবি নিয়ে এসেছিল। আবার ডিএনও টেস্ট করার কথা বলায় চলেও গেছে। তবে যিনি মিন্টুকে প্রথমে উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়েছিল আমরা সেই কামরুল ইসলাম চৌধুরীর সন্ধান পেয়েছি। তিনি এখন অস্ট্রেলিয়া থাকেন।  আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ আসবেন। আমরা তখন মিন্টোকেও আসতে বলেছি। আশা করি তখন সব সমস্যার সমাধান হবে।’