কারাগারের আদালতে খালেদা জিয়ার ৩০ মিনিট
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিশেষ আদালত আজ বুধবার রাজধানীর বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসার পরিবর্তে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যেখানে বন্দি,সেই নাজিমুদ্দিন রোডের পরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ বিষয়ে ‘গেজেট নোটিফিকেশন’ জারি করার পর আদালতের ভেতরে বিচার নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। এরই মধ্যে সাংবাদিক আইনজীবীকে কারাগারের ভেতরে স্থাপিত আদালতে প্রবেশ করানো হবে কি না এ নিয়ে সংশয় ও উদ্বেগ কাজ করতে থাকে।
আজ বুধবার সকাল ৯টার পর থেকে সাংবাদিকরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে উপস্থিত হতে থাকেন। তবে নিরাপত্তার কারণে কোনো ফটোসাংবাদিককে কারাগারের সামনে যেতে দেওয়া হয়নি। শুধু রিপোর্টারদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে কারাগারের সামনে উপস্থিত করা হয়। এরপর কারাফটকের সামনে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে সাংবাদিকরা। একপর্যায়ে বিচারকের বেঞ্চ অফিসার তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান,সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। তবে প্রত্যেক পত্রিকার মাত্র একজন করে।
কারাগারের ভেতরেই করা হলো এজলাস
এ সময় সাংবাদিকরা কারাগারের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে কারাগারের সামনে যান এ মামলার প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল। তিনি এসে সাংবাদিকদের প্রবেশ করানোর জন্য কারারক্ষীদের প্রতি আহ্বান জানান। কারাফটকে মোবাইল ফোন জমা রেখে সারিবদ্ধভাবে নাম নিবন্ধন করে কারাগারে স্থাপিত আদালতে প্রবেশ করানো হয় সাংবাদিকদের।
কারাগারে প্রবেশের পর ডান পাশেই আছে একটি কক্ষ। সেখানে আদালত স্থাপন করা হয়। এক সময় ওই কক্ষে আসামিরা স্বজনদের সঙ্গে দেখা করত। ৫০ ফুট লম্বা এবং পাশে ২০ ফুটের মতো জায়গায় আদালতের এজলাস বসানো হয়। তবে এর পাশে একটি কক্ষে সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষকদের বসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। বিচারকক্ষের পাশের রুমে বিচারকের খাস কামরার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু আদালতে এজলাসে উঠার জন্য কোনো দরজা ছিল না। বরং আসামি এবং আইনজীবীদের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে বিচারককে এজলাসে উঠতে হয়।
বেলা ১১টা ৭ মিনিটে একটি কালো রঙের গাড়িতে করে আদালতে প্রবেশ করেন বিচারক ড. আখতারুজ্জামান। এরপর বাড়ানো হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিচারক কারাগারে প্রবেশ করেই নিজের খাস কামরায় অবস্থান করেন।
হুইল চেয়ারে করে আদালতে যান খালেদা জিয়া
দুপুর ১২টা ১২মিনিটে একজন পুলিশ সুপারের (এসপি) নেত্বত্বে দুজন কারারক্ষী একটি হুইল চেয়ারে করে কারাগার থেকে আদালত কক্ষে খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসেন। এ সময় খালেদা জিয়ার পরনে ছিল বেগুনি রঙের শাড়ি। চেয়ারে বসা অবস্থায় তাঁর পায়ের ওপরের অংশ থেকে নিচ পর্যন্ত সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল। ডান হাতটা অনেকটা বাঁকা করে হুইল চেয়ারের উপরে রাখেন খালেদা জিয়া। বিচারকের সামনে একটি হুইল চেয়ারে তিনি বসে থাকেন। এ সময় তাঁকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তার হাত-পা এবং মাথা কাঁপছিল। তাঁর সঙ্গে এ সময় তাঁর গৃহকর্মী ফাতেমা ছিলেন। ফাতেমার হাতে ছিল একটি ছোট ব্যাগ।
দুপুর ১২টা ২৩ মিনিটে বিচারক এজলাসে উঠেন। এ সময় দুদকের আইনজীবী প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘আজ এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য ছিল। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়। এরপর থেকে অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়াকে এখন পর্যন্ত আদালতে হাজির করা যায়নি। তাঁর অসুস্থতা ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কারাগারে আদালত বসানোর বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনটি যথাযথভাবে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়াকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আর অন্য আইনজীবীদের ব্যক্তিগতভাবে আজকের শুনানির বিষয়ে জানানো হয়েছে। এমনকি বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা-সংলগ্ন অস্থায়ী আদালত যেখানে বসত সেখানেও তা (প্রজ্ঞাপন) টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এরপর তিনি আদালতের কার্যক্রম শুরুর আবেদন জানান।
এ সময় আদালত পর্যবেক্ষণে আসা ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তাফা খান খালেদা জিয়ার কোনো আইনজীবীকে দেখতে না পেয়ে তাঁর (খালেদা জিয়া) সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি আদালতের অনুমতি নিয়ে বলেন, ‘আমি এখানে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে এসেছি। খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনা করেন—এমন কোনো আইনজীবী আদালতে উপস্থিত হননি। রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী কারাগারে আদালত বসবেন—এ ধরনের প্রজ্ঞাপন গত রাতে আসামিপক্ষের এক আইনজীবীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে- এটা সঠিক নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবেই এখানে এসেছি। আমি মনে করি রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের মধ্যে কমিউনিকেশন গ্যাপ হয়েছে। আসামিপক্ষের অনেক আইনজীবী জানেন না এখানে মামলা পরিচালনা হবে। তাই আজ মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা সমীচীন হবে না। তাই আদালতকে সার্বিক বিবেচনায় নতুন তারিখ ধার্য করতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
‘সরকারের হুকুমে তিনি সব পরিচালনা করছেন’
খালেদা জিয়া আদালতকে বলেন, ‘জজ সাহেবের কাছে কোনো কথা বা নিবেদন করা যায় না। উনি তারিখ দিয়ে উঠে চলে যান। আমাদের কারো কথা শুনেন না। সরকারের হুকুমে এবং নির্দেশে তিনি সব কিছু পরিচালনা করছেন। আমার পায়ে ব্যথা। ডাক্তার আমাকে পা সব সময় উঁচু করে রাখতে বলেছেন। হাতেও প্রচণ্ড ব্যথা। আমাকে জোর করে এখানে আনা হয়েছে। আমি খুবই অসুস্থ। আমি ঘন ঘন কোনো হাজিরা দিতে পারব না। রায় তো লেখাই আছে। আমার হাত-পা প্যারালাইজড হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের যা ইচ্ছা রায় দেন, যত খুশি সাজা দিয়ে দেন।’
খালেদা জিয়া আরো বলেন, ‘এখানে যে আদালত বসানো হয়েছে এবং প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তা আমার আইনজীবীরা জানেন না। এটা জানলে আমি আসতাম না। আদালত পরিবর্তন হলে কমপক্ষে সাতদিন আগে নোটিশ দিতে হয়। তা জানানো হয়নি। তড়িঘড়ি করে বিচারের জন্য এ কারাগারের ভেতরে আদালত বসানোর এ আয়োজন। মাননীয় আদালত, আমি জানি এ আদালতে আমি ন্যায়বিচার পাব না। সরকারের নির্দেশে এ কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। আমি আর এই আদালতে আসব না।’
আদালত চলে আধা ঘণ্টা
এরপর আইনজীবী গোলাম মোস্তফা আদালতকে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত আমি মনে করি যথাযথভাবে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের জানানো হয়নি। ৫০ ফুটের একটি ছোট কক্ষে এভাবে মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে– এখানে আইনজীবী সাংবাদিক কেউ বসতে পারছেন না। এত বড় মামলা কারগারের ভেতরে পরিচালনা করা হবে তাও জানা ছিল না। দেশের ইতিহাসে এটি প্রথম। তাই প্রক্রিয়াটা যেহেতু যথাযথ হয়নি মামলার কার্যক্রম মুলতবি করে যথার্থ তারিখ ও যথার্থ স্থানে নির্ধারন করা হোক’। এরপর আদালত মামলার কার্যক্রম পরবর্তী ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর ধার্য করেন। এ সময় পর্যন্ত এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন বহাল রাখেন।
‘এখানে আমি ন্যায়বিচার পাব না’
এরপর খালেদা জিয়াকে পুলিশি প্রহরায় দুজন কারারক্ষী হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যান। এ সময় সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেন, ‘ম্যাডাম আপনি কেমন আছেন? কিছু বলবেন কি না?’ জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমার কোনো সিনিয়র আইনজীবী আদালতে ছিল না। তাদের যথাযথভাবে নোটিশ দেওয়া হয়নি। যে প্রজ্ঞাপন গত রাতে করা হয়েছে,তা সাতদিন আগে কেন হয়নি? আদালতকে জানিয়েছি, আমি অসুস্থ, বারবার আসতে পারব না। আমার হাত-পা প্যারালাইসড হয়ে যাচ্ছে। এখানে আমি ন্যায় বিচার পাব না এবং এরপর থেকে আমি আর এখানে আসব না।’
দেশে প্রথমবারের মতো কারা অভ্যন্তরে স্থাপিত এই আদালতে আসামিপক্ষের কোনো আইনজীবী ছিলেন না। আজ শুনানিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী বক্তব্য দেন। এ ছাড়া পর্যবেক্ষক হিসেবে ঢাকা জেলা বারের আইনজীবী গোলাম মোস্তফা বক্তব্য দেন।
আদালতে কারাগার বসানো উপলক্ষে সকাল থেকে কারাগার এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা নেওয়া হয়। কারাগারের সামনের সড়কে যানবাহন ও সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় মোট আসামি চারজন। খালেদা জিয়া ছাড়া অভিযুক্ত অপর তিন আসামি হলেন—খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন মোট ৩২ জন।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করা হয়।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশীদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামান। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ অন্য আসামিদের ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া অর্থদণ্ডও করা হয়। রায়ের পর খালেদা জিয়া রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজা ভোগ করছেন।