সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা
দেশের সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এরপর রয়েছে পাসপোর্ট, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বিচারিক সেবা, ভূমি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। আজ বৃহস্পতিবার দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত জরিপের ফলাফলে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আর এসব খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘুষ নিয়েছে বিআরটিএ।
টিআইবি জানায়, দুই বছর আগের জরিপের তুলনায় দুর্নীতির শিকার মানুষের সংখ্যা কিছুটা কমলেও ঘুষের পরিমাণ বেড়েছে। তাই পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
সেবা সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি ১৫টি খাতে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে টিআইবির ২০১৭ সালের সেবা খাতে দুর্নীতির জরিপে। জরিপে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে ৬৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে, যা আগের জরিপের তুলনায় এক শতাংশ কম। আর ঘুষ দিতে হয়েছে ৪৯ দশমিক আট শতাংশ। ঘুষ নেওয়ায় ক্ষেত্রে বিআরটিএর পরে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও পাসপোর্ট খাত। আগের জরিপে যেখানে গড় ঘুষের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৫৩৮ টাকা, নতুন জরিপে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৯৩০ টাকা। আগের চেয়ে দুর্নীতি বেড়েছে গ্যাস, কৃষি, বিচারিক সেবা ও বিদ্যুতে, আর কমেছে শিক্ষা, পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার ও ভূমিতে। অন্যদিকে কৃষি, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা ও বিমা খাতে ঘুষের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
জরিপ প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গাটি হচ্ছে যাদের দুর্নীতির মতো আইনের অপব্যবহার বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার কথা, আইনের অপব্যবহার প্রতিরোধ করা, তাদের সেই খাতগুলোতে কিন্তু দুর্নীতির ব্যাপকতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং শীর্ষস্থানে, মানে প্রথম সারিতে তাদের অবস্থান।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের জন্য আরো উৎকণ্ঠার বিষয় হচ্ছে যে, ৮৯ শতাংশ মানুষ বলেছে যে তারা ঘুষ দিতে বাধ্য। কারণ ঘুষ না দিলে তারা সেবা পাবে না। অর্থাৎ যারা অনিয়ম করে, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে এক ধরনের এটাকে এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে, এটা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, এর ফলে যারা ঘুষ দিতে বাধ্য হয় তারা এটাকে জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে মেনে নেওয়ার মতো অবস্থায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘যারা সরকারি চাকরিজীবী তারাও কিন্তু দুর্নীতির শিকার হচ্ছে এবং তাদের ক্ষেত্রে এই হারটি হচ্ছে ৬১ শতাংশ। সরকারি খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ফলে আমরা অনেকেই আশা করেছিলাম হয়তোবা দুর্নীতি কমবে উল্লেখযোগ্য হারে, কিন্তু যারা ঘুষ আদায়ে অভ্যস্ত তাদের জন্য এই যে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি কোনো উপাদান না।’
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘ঘুষ না দিলে সেবা না পেলে যার সেবা পাওয়ার কথা সে কেন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হচ্ছে? তাকে কেন আমরা জবাবদিহিতার সম্মুখীন করতে পারছি না?’ তিনি বলেন, ‘এবার তো আবার নির্বাচনেরও বছর। নতুন করে আমরা অনেক অঙ্গীকার দেখব, নির্বাচনী ইশতেহারও দেখব, সেখানেও হয়তো এই কথাগুলো থাকবে। কিন্তু আমাদের যে আবেদনটা থাকবে, যে কথাগুলো বলা হয় সেই কথাগুলো যেন কার্যকর করা হয়।’
টিআইবির জরিপে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। আর মাথাপিছু ঘুষ ৬৫৮ টাকা। শহরের তুলনায় গ্রামে ঘুষ-দুর্নীতি বেশি। আর ধনীদের তুলনায় গরিবদের ২০ গুণ বেশি অর্থ ঘুষে খরচ হয়। শিক্ষিতদের চেয়ে অশিক্ষিতদের খরচটাও বেশি। তবে তরুণরা অপেক্ষাকৃত কম ঘুষ দিয়ে থাকে।
ঘুষ-দুর্নীতি কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি করার পাশাপাশি সেবা খাতের ডিজিটালাইজেশন, তথ্য প্রকাশ ও তরুণদের সচেতনতা বাড়ানোসহ ১২ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।