দাম ভালো থাকায় ব্যস্ত পাটচাষিরা
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাটচাষিরা। জমি থেকে পাটগাছ কাটা, আঁটি বেঁধে পানিতে জাঁক (ভিজিয়ে রাখা) দেওয়া, পাট ছাড়ানো, পাট-পাটকাঠি রোদে শুকানো, বিক্রি করা নিয়ে এখন ব্যতিব্যস্ত তাঁরা।
এত পরিশ্রমের পরও যেন ক্লান্তি ভর করছে না চাষিদের মনে। কেননা এবার পাটের বাজারদর গত বছরের তুলনায় বেশ ভালো। পাট চাষে মুনাফা হওয়ায় খুশি ভৈরবের কৃষকরা।
এদিকে চাষিদের সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন পাট ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও।
একটা সময় ছিল যখন পাটকে বলা হতো ‘সোনালি আঁশ’। সে সময় বিদেশে রপ্তানি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে পাটভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে উঠায় পাট ছিল দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। কিন্তু কালের আবর্তে সে দৃশ্য পাল্টে যায়। ‘সোনালি আঁশ’খ্যাত পাট পরিণত হয় কৃষকের ‘গলার ফাঁসে’। তাই পাটের আবাদ প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল কৃষক।
কিন্তু বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে পাটের হারানো গৌরব ফিরতে শুরু করেছে। সেসব উদ্যোগের ফলে পাটের মণপ্রতি দর এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। এখন সেটা বেড়ে এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অথচ কয়েক বছর আগেও মণপ্রতি পাটের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
এ ছাড়া ২০১৪ সালে বিভিন্ন পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন পাস করে সরকার। যার ফলে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনির ক্ষেত্রে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এর ফলে ওই বছর রাতারাতি পাটের দর মণপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্তও উঠে যায়।
পাটের ভালো বাজার দর তৈরি হওয়ায় পাটচাষ বেড়ে চলেছে বিভিন্ন এলাকায়। এ ধারা অব্যাহত থাকলে পাটের হারানো ঐতিহ্য আবারও ফিরে আসবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
যদিও গত বছর হঠাৎ করে পাটের দর আবারও কিছুটা কমে যাওয়ায় কৃষকদের মুনাফায় টান পড়ে। কিন্তু এবার তাঁর পুনরাবৃত্তি না হওয়ায় খুশি কৃষকরা।
উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের ঝগড়ারচর গ্রামের কৃষক মো. জাহাঙ্গীর মিয়া, হযরত আলী, আদর্শপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা রহমত উল্লাহ ভূঁইয়া ও মো. রহিম উদ্দিন জানান, প্রতি বিঘা পাট চাষে তাঁদের খরচ হয় আট থেকে ১০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ছয় থেকে সাত মণের মতো পাট হয়। মণপ্রতি পাটের বাজার দর কমপক্ষে দুই হাজার টাকা থাকলে তাঁরা কিছুটা লাভবান হতে পারেন। কিন্তু এর কম হলে নিজেদের পকেটে বলতে গেলে কিছুই ঢুকবে না বলে জানান তাঁরা। সে ক্ষেত্রে কেবল পাটখড়িই লাভের অংশ হিসেবে থাকে।
এক বিঘা জমি থেকে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার পাটখড়ি বিক্রি করা যায় বলে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
চলতি মৌসুমে পাট বেচাকেনা লাভজনক হওয়ায় পাটের ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা এরই মাঝে এলাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরে কৃষকদের থেকে পাট কিনে আশপাশের বিভিন্ন মোকামে বিক্রি করতে শুরু করেছেন। ফড়িয়া ব্যাবসায়ীদের কারণে পাট বিক্রি করার পরিশ্রম কমে যাওয়ায় কৃষকরা যথেষ্ট খুশি।
কটিয়াদির ফড়িয়া ব্যবসায়ী মো. সায়েদুর রহমান, বাজিতপুরের মো. আব্দুর রশিদ ও কুলিয়ারচরের শিশু মিয়ার সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, গত বছর যেখানে মণপ্রতি পাটের দর ছিল এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার সাড়ে ৬০০ টাকা, সেখানে এবার মৌসুমের শুরুতেই প্রতি মণ পাট এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনে তাঁরা রায়পুরা, বেলাবো, কটিয়াদি, বাজিতপুর এলাকায় সেগুলো বিক্রি করে মুনাফা করছেন বলে জানান।
ভৈরব উপজেলার কৃষি বিভাগ জানায়, প্লাস্টিকের বস্তা উঠিয়ে দিয়ে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ এলাকায় পাটের আবাদ বেড়েছে। চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে এক হাজার ১০০ হেক্টরের হলেও আবাদ হয়েছে এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। পাটের বাজার দর মণপ্রতি কমপক্ষে দুই হাজার টাকায় স্থিতিশীল থাকলে, পাটের আবাদ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে বলে উপজেলা কৃষিবিভাগের ধারণা।
কৃষি কর্মকর্তা মো. জালাল উদ্দিন প্রধান জানান, পলিথিন জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করায় পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। পাটের বাজারদর ভালো থাকায় কৃষক পাট চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তাঁরাও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সার-বীজ ইত্যাদি বিতরণসহ নানাভাবে কৃষকদের সহায়তা করে যাচ্ছেন। তাঁর আশাবাদ, এভাবে পাটচাষ চলতে থাকলে পাট আবারও তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।