‘বিষ খাই মরি যাইয়ুম, বার্মাত ন যাইয়ুম’
‘হেরার মধ্যে সকল ইনসানের নাম আছে। আঁরা মুসলমান রোহিঙ্গার কোনো নাম নাই। তো আঁরা রোহিঙ্গারা নাম চাই। নাম পাইলে আঁরা যাইয়ুম। আঁরা ন যাইয়ুম। আঁরারে বাংলাদেশ সরকার জায়গা দিছে। আঁরারে যদি বার্মা নিয়া যাইতে চায়, আঁরা বিষ খাই মরি যাইয়ুম। তাঁরা বিষ খাওয়াইলে আঁরা খুশি খুশি বিষ খাই মরি যাইয়ুম। তবু ওইখানে গিয়ে ওই জুলুমের শিকার আর ন হইয়ুম।’
নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জিজ্ঞেস করতেই কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়া এক রোহিঙ্গা পুরুষ।
আজ শনিবার নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে লাখো রোহিঙ্গার বাংলাদেশে পালিয়ে আসার এক বছর পূর্ণ হলো। গত বছর ঠিক ২৫ আগস্টেই রোহিঙ্গা নাগরিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আর এখন পর্যন্ত এই নির্যাতনের বিচারের কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। দেখা যায়নি, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের কোনো উদ্যোগ।
এদিকে, প্রত্যাবাসন আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে অবিশ্বাস জোরালো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মাঝে। কেউ কেউ বলছে, বিচার না হয়ে দেশে ফিরিয়ে নিলে আবারও নির্যাতনের শিকার হবে তারা।
গত বছর এভাবেই রোহিঙ্গারা ভেলায় করে বা নৌকায় করে নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। ছবি : এনটিভি
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কথা বলেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ডিরেক্টর অব ইমার্জেন্সি আহমেদ ওয়ারসামি। তিনি বলেন, ‘যদি রোহিঙ্গা শরণার্থীরা স্বেচ্ছায় বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের দেশের সব খবর জেনে। তারা যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে যেতে পারে সে ব্যাপারে আমরা । তাদের সহায়তা করব। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা তাদেরই নিতে হবে এবং ইউএনএইচসিআর তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে কেউ জোর করছে না। মিয়ানমার সীমান্তের কী অবস্থা সেদিকেও আমরা খেয়াল রাখছি এবং এরা একদিন দেশে ফিরে যেতে প্রত্যয়ী হবে বলে আশা করি।’ তাঁর বক্তব্যে অনেকটাই পরিষ্কার যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হয়তো খুব দ্রুতই হচ্ছে না।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মুহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো মিয়ানমারে যেতে চায় না তাঁরা, তাদের নিরাপত্তার জন্য। কাজেই সার্বিক পরিস্থিতি সেখানে একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, তাদের নিজ নিজ গ্রামে বা নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, এই বিষয়গুলো মিয়ানমারের দিকে আছে। এখন যেহেতু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের কাজের সাথে সম্পৃক্ত করতে রাজি হয়েছে তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এটি সামনের দিকে হয়তো আমরা কিছু অগ্রগতি দেখতে পাব।’
বেসরকারি সংগঠন ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস বলেন, ‘হঠাৎ করেই বিপুল মানুষ যখন অবস্থান নিয়েছে, তখন আমরা খুব তড়িৎগতিতে অ্যাকশন নিই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হিউমেনিটেরিয়ান কমিটির পক্ষ থেকে আমরা চেষ্টা করি তাদের তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার। চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার বা ওয়াটার, সেনিটেশনের ব্যবস্থা করার। সে সময় উখিয়া টেকনাফে বর্ষাকাল চলছিল আপনারা জানেন, সেই বর্ষার মধ্যে প্রচুর মানুষ বর্ডারে মানবেতর জীবনযাপন করেছে। সে সময় অবস্থান নিয়েছে খালের পাড়ে, পুকুর পাড়ে , নাফ নদের তীরে তারা অবস্থান নিয়েছে এবং অনেক নারী, শিশু বয়োবৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষকে আমরা, প্রত্যক্ষ করেছি সে সময়। সেই সময়ে বাংলাদেশ সরকার তাদের উদারতা দেখিয়েছে। যেখানে, বিশ্বের অনেক সম্পদশালী দেশ তাদের বর্ডার বন্ধ করে রেখেছে, নিপীড়িত মানুষের জন্য সেখানের বাংলাদেশ সরকার, একটি ছোট দেশ, অনেক জনসংখ্যার দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা তাদের বর্ডার ওপেন করেছে। এই মানুষগুলোকে আশ্রয় দিয়েছে। না হলে হয়তো অনেক মানুষের জীবন বিপন্ন হতো। তো সেখান থেকে আমরা দেখেছি যে, বাংলাদেশ সরকার প্রায়, দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ দিয়েছিল, সেখানে তাদের অস্থায়ী শেলটার করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু অচিরেই আমরা দেখতে পেয়েছি যে, এত বেশি লোক আসা শুরু করেছে, তখন দুই হাজার একরে হয়নি, এখন পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যেখানে ৩০টির মতো ক্যাম্প করে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আপনারা জানেন যে কুতুপালংয়ে বলা হয় যে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিফিউজি ক্যাম্প। যেটা ম্যাগা ক্যাম্প নামে পরিচিত। সেখানে ২০টির মতো ক্যাম্প ভাগ করে মানুষ অবস্থান নিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে সাম্প্রতিক বা অতীতে আমরা অত বড় ক্যাম্প এবং এত বড় ক্রাইসিস আমরা আর দেখিনি। তো সেখান থেকে গত এক বছরের তুলনায় অনেক বেশি সুগঠিতভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে, আমরা তাদের মানবিক সহায়তাটা দিচ্ছি এবং এখানে স্থানীয় প্রশাসন সহায়তা করছে, জেলা প্রশাসন সহায়তা করছে।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। হত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইন ছেড়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা।
এর আগে উপস্থিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি। এ বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার রোহিঙ্গা এসেছেন বাংলাদেশে। উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা ভূমিধসসহ প্রতিকূল আবহাওয়ায় নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনলেও এই শরণার্থীর জীবন কতটা দীর্ঘ হবে তা জানে না তারা।
এর আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে মিয়ানমার সরকার নতুন আসা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে গত নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও তাতে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।