‘মালামাল হাউসফুল, বিক্রি কম’
ঈদুল আজহা যত এগিয়ে আসছে, তত বাড়ছে কামারপাড়ার ব্যস্ততা। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই এখানকার কারো। দুপুরের তীব্র গরমের মধ্যে শরীরে ঘাম ঝরিয়ে চুলার কাছে বসে একমনে বানিয়ে চলেছেন পশু জবাইয়ের উপকরণ। ক্রেতার চাহিদার কথা ভেবে বছরের এই একটি সময়েই দিন-রাত একাকার করে কাজ করেন এখানকার কামাররা।
আজ শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কামারপাড়ায় গিয়ে, গড়গড়ে আগুনে লোহা জ্বালানো, হাঁপরের শোঁ শোঁ টান, তপ্ত লোহায় হাতুড়ি পেটানোর শব্দ, ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরি—এসব সনাতনী দৃশ্যের সঙ্গে চোখে পড়ে অত্যাধুনিক ইলেকট্রিক যন্ত্র দিয়ে অস্ত্রে শান দেওয়ার কিছু দৃশ্যও। ছুটির দিন বলে ক্রেতাদের ভিড় সাধারণ দিনের একটু বেশি বলে মনে হলেও বিক্রেতারা জানান, এখনো তাদের ঈদের বাজার জমে ওঠেনি।
আগামী ২২ আগস্ট সারা দেশে একযোগে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। ত্যাগের নিদর্শন হিসেবে পশু কোরবানি দেওয়া এই ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ। এরই মধ্যে রাজধানীর ২৯টি স্থানে জমে উঠছে কোরবানির পশুর বাজার। ঢাকার আশপাশ বা বাইরের জেলা থেকে আসা এসব পশুর মূল ক্রেতা রাজধানীবাসীই।
গত রোববার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এবার কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর মধ্যে ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার গরু ও মহিষ এবং ৭১ লাখ ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে পাঁচ কোটি ৩৬ লাখ ৫৪ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। এর মধ্যে এক কোটি ১৫ লাখ ১৭ হাজার কোরবানির উপযোগী। সব মিলিয়ে এবার এক কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এসব কোরবানির পশু জবাই করার জন্য মূলত এই সময়ে চাপাতি, ছুরি, দাসহ অন্যান্য অস্ত্র তৈরির ব্যস্ততা বেড়ে যায় কামারপাড়ায়। কামারিরাও সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন এই সময়টায়। তবে গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় তাঁরা বলছেন, কামারপাড়ায় বানানো অস্ত্রের পাশাপাশি এখন চীন থেকে আমদানি করা অস্ত্রের দিকেও ঝুঁকছেন মানুষ।
কারওয়ান বাজারের দোকানিরা বলছেন, গতকাল থেকে দু-একটি করে অস্ত্র বিক্রি হওয়া শুরু হয়েছে। বলা চলে, ঈদের বেচাকেনা শুরুই হয়নি এখনো। তবে পশু জবাইয়ের উপকরণ তৈরির কাজ সেরে রাখছেন তাঁরা। আশা করছেন, আগামীকাল শনিবার থেকে শুরু হয়ে যাবে পুরোদমে বিক্রি।
মো. আবদুল গণি নামের এক ব্যবসায়ী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অন্যবার কোরবানির অন্তত ১০ দিন আগে থেকে কম করে হলেও চাপাতি, দা, ছুরি এবং বঁটি বিক্রি হওয়া শুরু হয়ে যায়। তবে এবার মালামাল হাউসফুল হলেও বিক্রি কম। দেখা যাক, সামনে কেমন বেচাকেনা হয়।’
বাবুল হোসেন নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আজ সারা দিনে মাত্র দুটি চাপাতি আর তিনটা ছুরি বিক্রি করেছি। অথচ অন্যবার ঈদের পাঁচ-সাত দিন আগে থেকে মোটামুটি বিক্রি শুরু হয়ে যায়। তবে ঈদের বিক্রি হয় মূলত তিন দিন। ঈদের আগের তিন দিনে দোকান খালি হয়ে যাবে প্রায়।’
দেব চক্রবর্তী নামের অনেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ইস্পাত এবং লোহার দাম বেড়ে যাওয়াতে সব ধরনের কোরবানির পশু জবাইয়ের উপকরণের দাম বেড়ে গেছে অন্যবারের চেয়ে। ইস্পাতের দা ৬০০ টাকা কেজি, লোহার দায়ের দাম তার অর্ধেক, চাপাতি প্রতিটি ৪০০-৫০০ টাকা দরে, বঁটি ৫০০ টাকা কেজি, গরু বা ছাগল জবাই করার বড় ছুরি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় ছুরি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত। লোহার চেয়ে ইস্পাতের সব ধরনের জিনিসের দাম প্রায় দ্বিগুণ।’
দেব আরো বলেন, ‘তবে আপনাকে যে দাম বললাম, এই দামের বাইরেও বিক্রি হয় বা হবে। কোরবানি উপলক্ষে যার কাছ থেকে যেমন নেওয়া যায়।’
রুহুল আমিন নামের এক ক্রেতা এসেছেন দা কিনতে। তিনি বলেন, ‘বাসায় ছুরি আছে শুধু দা হলেই চলবে। তবে দাম একটু বেশি মনে হচ্ছে। একটি দার দাম বলছে ৬০০ টাকা। কিছু করার নেই। একটা তো কিনতেই হবে।’
কারওয়ান বাজারের কামার সঞ্জয় চন্দ্র বলেন, ‘ঈদের জন্য অনেক মাল (পশু জবাইয়ের উপকরণ) বানানো হয়েছে। হের পরেও বানানো হবে। নইলে ঈদের তিন দিন আগে থেকে যেভাবে মানুষজন কিনতে আসে, বাড়তি মাল না থাকলে সেই সময় বিক্রি করার মতো মাল থাকে না। এক মালিকের দোকানে আমরা চারজন কাজ করছি সব সময়। এভাবে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত বানাতে হবে।’
বৈদ্যুতিক মেশিনে দা ধার দিচ্ছেন ইন্দ্রজিৎ নামের এক কামার। কখনো সমস্যা হয় না কাজ করতে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দুই মাস আগে রাজীব ঘোষ নামের একজন কামারের হাত ঝলসে গেছিল। তাঁর হাত এখনো ঠিক হয়নি। এসব কাজ ভয় নিয়েই করতে হয়। কারণ হাতে প্রচুর কাজ থাকে। আস্তে করার সুযোগ থাকে না। তবে প্রতিদিন ৮০০ টাকা মজুরি পাই, ভয় নিয়ে তো একটু কাজ করতেই হয়।’
দিনে কতটা অস্ত্র তৈরি করতে পারেন—এমন প্রশ্নে মো. নাঈম নামের এক কামার বলেন, ‘পুরোনো কাজ বেশি করছি এবার। নতুন কাজ পুরোনো কাজের চেয়ে কম। একদিনে ছোট-বড় মিলে নতুন মাল খুব বেশি হলে ৬০টি বানানো সম্ভব। আর পুরোনো মালের তো ধার দিলেই শেষ।’