বঙ্গবন্ধুর প্রথম শাহাদাত বার্ষিকী পালন করায় কারাভোগ, আজ অবহেলিত
সময়টা ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকী। দেশ তখন সামরিক সরকারের দখলে। জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করা তখন এক রকম দুঃসাহসিকতার পরিচয়। কিন্তু এসব তোয়াক্কা করেননি কিশোরগঞ্জের ভৈরবের কিছু যুবক। অংশগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্যে আয়োজিত মিলাদ মাহফিলে। আর এজন্যে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ, চালায় অমানুষিক নির্যাতন। পরে তাঁদের ছয় মাস থেকে এক বছরের জেল হয়।
আজ ২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকী। সারা দেশে নানা আয়োজনে পালন করা হলো জাতীয় শোক দিবস। কিন্তু কোথায় সেদিনের সেই ২২ যুবক?
জানা যায়, সেই ২২ জনের মধ্যে মারা গেছেন ছয়জন। জীবিত বাকি ১৬ জনের খোঁজ আজ আর কেউ রাখে না। আজ বুধবার কথা হয় তাদেরই একজনের সঙ্গে। তিনি জানান, এ ৪২ বছরে পাওয়া অবহেলার কথা।
কথা হয় সেদিনের গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান ফারুকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৬ সালে সামরিক সরকারের ভয়ে তখন এদেশের গাছের পাতাও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতো না। কিন্তু আমরা ২২ জন সেদিন সাহসিকতার সাথে প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে মিলাদের আয়োজন করেছিলাম। এখনকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কেউ আমাদের কথা মনেও করে না। প্রতি বছর বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবসে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত দেয় না।’
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকীতে ভৈরবে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। তৎকালীন থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম আক্কাছ ও ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান ফারুকের উদ্যোগে তৎকালীন হাজি আসমত কলেজের শহীদ আশুরঞ্জন ছাত্রাবাসে (বর্তমানে শৈবাল হোটেল) মিলাদ মাহফিল হয়। আয়োজনের মধ্যে ছিলো মিলাদ মাহফিল, কোরআন খতম ও দোয়া মোনাজাত।
ওই দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ১২ জন মৌলভী ছাত্রাবাসে এসে কোরআন খতম শুরু করেন। বিকেল ৪টার মধ্যে একে একে ২২ জন নেতাকর্মী মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। মিলাদ মাহফিলে সেদিন অনেককে নিমন্ত্রণ করলেও সামরিক সরকারের পুলিশের ভয়ে অনেকেই উপস্থিত হতে সাহস করেননি। কিন্তু একে একে উপস্থিত হন ২২ যুবক।
তাঁরা হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম আক্কাছ (বর্তমানে ভৈরব পৌরসভার মেয়র), আসাদুজ্জামান ফারুক (বর্তমানে সাংবাদিক), রুহুল আমিন, মাহাবুব (বর্তমানে মৃত), মতিউর রহমান, মফিজুর রহমান, মোশারফ হোসেন জজ মিয়া (বর্তমানে মৃত), জিল্লুর রহমান জিল্লু (বর্তমানে মৃত), আসাদ মিয়া (বর্তমানে মৃত), আতাউর রহমান, আসাদুল হক শিশু, দীলিপ চন্দ্র সাহা ও তাঁর ভাই দিপেন্দ্র চন্দ্র সাহা, ফজলুর রহমান (বর্তমানে মৃত), আবদুল হামিদ, ইদ্রিছ মিয়া, মাহবুব আলম, রসরাজ সাহা, সুবল চন্দ্র কর (বর্তমানে মৃত), শাহজালাল হোসেন, আজমল ভূইয়া ও ফিরোজ মিয়া।
কিন্তু, মিলাদ শুরুর আগেই এ খবর পৌঁছে যায় সামরিক সরকারে উচ্চ মহলে। তাৎক্ষণিক ওয়ারলেস ম্যাসেজ পেয়ে ভৈরব থানার ৪০-৫০ জন পুলিশ সদস্য ছাত্রাবাসটি ঘিরে ফেলে। সেদিন পুলিশ ছাত্রাবাসে প্রবেশ করেই মাওলানাদের কোরআন খতম বন্ধ করে দিয়ে গালিগালাজ শুরু করে। লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে সবাইকে। এ সময় ফখরুল আলম আক্কাছ পুলিশের উপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তাঁকে বেধরক পেটানো হয়।
১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ২২ জনের মধ্যে নয়জন। পুরোনো ছবি : সংগৃহীত
তারপর সবাইকে ভৈরব থানায় নেওয়া হয়। থানায় নিয়ে সারারাত ২২ জনকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। পরদিন ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কিশোরগঞ্জ মহকুমা আদালতে চালান দেওয়া হয়। মৌলভীদের থানায় নেওয়ার পর মুচলেকা রেখে (মুচলেকায় বলা হয়, ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর কোনো মিলাদ আয়োজনে তাঁরা যাবে না) ছেড়ে দেওয়া হয়। আদালত জামিন না দিয়ে সেদিন ২২ জনকেই কারাগারে পাঠিয়ে দেন। সেই সময় কারাগারে তাদের কয়েকজনকে ফাঁসির আসামির কক্ষে রাখা হয়। পরে ফখরুল আলম আক্কাছ প্রায় এক বছর ও আসাদুজ্জামান ফারুক ছয় মাস এবং অন্যান্যরা কয়েকমাস করে কারাভোগের পর পর্যায়ক্রমে জেল থেকে মুক্তি পান।
তাদের মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন। এখনও ১৬ জন বেঁচে থাকলেও তাদের খবর কেউ রাখে না। তাঁরা আজ অবহেলিত। কেউ কেউ নিদারুণ অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বলেও তাঁরা জানান।