লোকসানের শংকায় ভারতীয় গরুর প্রবেশ বন্ধ চান খামারিরা
কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও কুলিয়ারচরে কোরবানির পশুর চাহিদা মেটাতে ১০ হাজারেরও বেশি খামারের খামারিরা প্রস্তুতি নিয়েছে এবার। তাদের ওইসব খামারে দেশীয় খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তারা মোটা-তাজা করেছে তাদের গরু-ছাগল ও মহিষগুলোকে।
গড়ে ওঠা এসব খামারে ক্ষতিকারক স্ট্রেরয়েড জাতীয় মেডিসিন ব্যবহার হচ্ছে না বলে দাবি খামারিসহ স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের।
তবে খামারিদের অভিযোগ, ঈদের আগে ভারতীয় গরু প্রবেশ করলে লোকসান গুনতে হয় তাদের। তাই সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দাবি করেছে তারা।
ভৈরব ও কুলিয়ারচর উপজেলায় কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারও গড়ে উঠেছে এসব মৌসুমি পশুর খামার। ওই সব খামারে দেশি, নেপালি, সিন্ধি, শংকর জাতীয় গরুসহ মহিষ ও ছাগল পালন করা হচ্ছে। আর ওই সব খামারের পশুকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে দেশীয় খাবার খড়, খৈল, ভুষি, গুড়ের চিটা, লবণ, চাল-ডালের ছোলা-গুড়াসহ চাষ করা লিপিয়ার, পাঞ্চন ঘাস খাওয়ানো হচ্ছে। ব্যবহার হচ্ছে না মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর স্ট্রেরয়েড জাতীয় কোনো মেডিসিন। ফলে এখানকার উৎপাদিত কোরবানির পশু থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মাংস পাওয়া যাবে বলে দাবি খামারিসহ স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের।
খামারিরা জানায়, গরু হৃষ্ট-পুষ্ট করার কাজটি লাভজনক। তবে পশু খাদ্যের দাম প্রতি বছরই বেড়ে যাওয়া এবং ঈদের আগে প্রতি বছর ভারতীয় গরু প্রবেশের ফলে তাদের লোকসান গুনতে হয়। এ বছরও এমনটিই আশংকা তাদের। অন্যদিকে এই খাতে সরকারিভাবে তাদের জন্য ঋণ দিলে তারা খামারে পশুর সংখ্যা বৃদ্ধিসহ আরো লাভবান হতে পারত।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ কামরুল ইসলাম, ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তানজিলা ইভার সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং টিম এলাকার ফার্মেসিগুলোতে অভিযান পরিচালনা করছে। ছবি : এনটিভি
কুলিয়ারচরের রামদি ইউনিয়নের উত্তর জাফরাবাদ গ্রামের খামারি মো. আবু তাহের প্রধান জানান, ১৯৭৪ সাল থেকে তিনি পশু মোটা-তাজাকরণ পেশার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে চার-পাঁচটি পশু দিয়ে শুরু করলেও এখন তিনি ২০ থেকে ২৫টি পশু লালন-পালন করেন। এ বছরও ২৪টি গরু ও একটি মহিষ মোটা-তাজা করেছেন। তাঁর পশুগুলো কোরবানির ঈদের জন্য প্রস্তত আছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, পুরোপুরি দেশীয় খাবারে মোটা-তাজা করা হয়েছে খামারের পশুগুলো।
এত বছর ধরে এই পেশায় জড়িত থাকলেও, কখনো তাঁর লোকসান গুনতে হয়নি বলে জানান আবু তাহের প্রধান। কোরবানির ঈদের ছয় মাস পর থেকে তিনি আশপাশের বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে শুকনা পশুগুলো কম দামে কেনেন বলে জানান। পরে সেইগুলো যত্নের সঙ্গে পরিচর্যা করে হৃষ্ট-পুষ্ট করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেন। তাঁর মতে, পশু কেনার সময় খামারিরা একটু সচেতন হয়ে পশু কিনলে এবং লালন-পালনে অধিক মনোযোগী হলে লোকসানের কোনো কারণই থাকবে না।
এদিকে কুলিয়ারচর পৌর এলাকার বড়খারচর এলাকার খামারি নূর মোহাম্মদ টুটন, উছমানপুর ইউনিয়নের বরাডুল গ্রামের আনিস মেম্বার, ভৈরব পৌর এলাকার আব্দুল খালেক, আলকাছ মিয়া এবং আগানগর ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের মজিবুর মিয়া ও শিমূলকান্দি ইউনিয়নের পাঁচঘর হাঁটির নাছির মিয়ার জানান, প্রতি বছরই পশু খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। পশু মোটা-তাজাকরণ খাতে স্বল্প মেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা থাকলে তাঁরা খামারে পশুর সংখ্যা বৃদ্ধিসহ কোরবানির হাটে বিক্রি করা পর্যন্ত খরচ জোগানে স্বস্তিতে থাকতে পারতেন। কারণ, অনেক সময় খামারের খরচ জোগাতে গিয়ে তারা পুঁজিহারা হয়ে পড়েন। এতে করে অনেক সময় উচ্চ সুদে মহাজনী ঋণ গ্রহণে বাধ্য হন। ফলে লাভের একটা বড় অংশ তখন চলে যায় মহাজনদের পকেটে।
এদিকে এসব মৌসুমি খামার করে যে কেবল খামারিরাই লাভবান হচ্ছে, তা নয়। এখানকার খামারগুলোতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে বহু লোকের। প্রায় প্রতিটি খামারে দুইয়ের অধিক শ্রমিক কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। ওই সব শ্রমিক খামারে কাজ করে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ ভালো আছে বলেও জানায় শ্রমিকরা।
খামার শ্রমিক শহীদ মিয়া, আজগর আলী ও রেহেনা বেগম জানান, খামারে কাজ করে তাঁরা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মাসিক বেতনে কাজ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ ভালো আছেন।
ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ কামরুল ইসলাম জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও ভৈরবে প্রাকৃতিক উপায়ে কোরবানির পশু মোটা-তাজাকরণ খামার গড়ে ওঠেছে। ওই সব খামারে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে পশু মোটা-তাজাকরণ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, নিরাপদ ও বিষমুক্ত মাংস নিশ্চিত করতে প্রতি নিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে খামারগুলো। সেজন্য উপজেলার একটি পৌরসভাসহ সাতটি ইউনিয়নে আটটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলো প্রতিনিয়ত খামারসহ স্থানীয় ওষুধের দোকানগুলো পরিদর্শন করছে।
এ ছাড়া খামারিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, টেকনিক্যাল সহযোগিতা, বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ ও চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি এই কর্মকর্তার।
এদিকে নিরাপদ মাংস নিশ্চিত করতে সুস্থ পশু লালন-পালনে খামারিদের সব সহযোগিতা প্রদান এবং যাতে কোনো প্রকার অসাধু পথ গ্রহণ করতে না পারে, সেজন্য পর্যবেক্ষণ টিম গঠনের কথা জানালেন কুলিয়ারচর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নিখিল চন্দ্র দেবনাথও। তিনি তাঁর উপজেলার পশু হৃষ্টপুষ্ট করা খামারগুলো দেখ-ভাল করতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও মসজিদের ইমামদের সমন্বয়ে পর্যবেক্ষণ টিম গঠনের কথা জানান। এলাকার কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণসহ খামারিদের আর্থিক লাভের জন্য এই পেশাটি একটি বেশ মুনাফাজনক বলে অভিমত এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার।