সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ
দুর্ঘটনায় নরহত্যার জন্য বাসচালক ও তাদের সহকারীদের মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজার বিধান রেখে যে সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে আজ সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন মালিক-শ্রমিকরা।
রাজধানীর কুর্মিটোলার বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাসের রেষারেষির কারণে দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবির মুখে সরকার দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইনের খসড়াটি পাস করার কথা জানায়। এটি খুব দ্রুতই সংসদে পাস হতে যাচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
খসড়া আইনটিতে ‘দুর্ঘটনার সাজা দণ্ডবিধিতে’ বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার জন্য শাস্তি দেওয়া হবে দণ্ডবিধি অনুযায়ী। নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড। হত্যা না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪(বি) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের কারাদণ্ড হবে।
এই প্রস্তাবিত আইনের প্রতিবাদেই আজ শুক্রবার সকাল থেকে সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে বাস মালিক ও শ্রমিকরা। এ ছাড়া তাঁরা সড়কে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণও দেখিয়েছেন।
সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় বাস চলাচল বন্ধের ডাক দিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। ফলে পরিবহন সংকটে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ যাত্রীরা।
বিভিন্ন জেলা থেকে এনটিভি অনলাইনের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
ঢাকায় নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, আজ ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে যাত্রীবাহী বাস নেই বললেই চলে। সকাল সাড়ে ৮টায় দেখা যায়, সড়কে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস চলাচল করছে। ছুটির দিনে সাধারণত বাসের সংখ্যা কম থাকে। কিন্তু আজ আক্ষরিক অর্থে দু-একটি বাস ছাড়া গণপরিবহন দেখা যায়নি।
কিছু পুলিশবাহী যানবাহন দেখা গেছে। এর ফলে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। শত শত মানুষকে রাস্তায় হাঁটতে দেখা গেছে।
রাজধানীর রোকেয়া সরণি, মিরপুর রোড, সাতমসজিদ রোড, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, প্রগতি সরণি, এলিফ্যান্ট রোড ঘুরে কোনো গণপরিবহন দেখা যায়নি।
এদিকে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে পরিবহন সংকটের কারণে বাসযাত্রীরা পড়েছে চরম দুর্ভোগে। সকাল থেকে মহাসড়কে দূরপাল্লা ও লোকাল কোনো বাসই চলাচল করেনি।
মহাসড়কের আমিনবাজার, হেমায়েতপুর, সাভার, নবীনগর, বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে সকাল থেকে যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ দেখা যায়। দেখা যায়, গাড়ি না পেয়ে বাসস্ট্যান্ডেই বসে রয়েছেন যাত্রীরা।
রাজশাহী থেকে শ ম সাজু জানিয়েছে, এদিকে, আজ রাজশাহীর সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। বাস ভাংচুরের প্রতিবাদে এবং নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে আজ সকাল থেকে রাজশাহী ঢাকাসহ দূরপাল্লা ও আন্তজেলা রুটের সব বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জানা যায়, বাস চলাচল বন্ধের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে বাস মালিকদের সংগঠন রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপও।
আজ রাজশাহীর সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। ছবি : এনটিভি
এদিকে, এভাবে আকস্মিক বাস বন্ধের ফলে দুর্ভোগে পড়েছে যাত্রীরা। তবে রাজশাহীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বিআরটিসির বাসগুলো নিয়ম অনুযায়ী চলছে বলে জানা যায়।
পাবনা থেকে এ বি এম ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, এদিকে যানবাহন ভাঙচুরের প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডেকেছে মালিক-শ্রমিকরা সংগঠন। আজ শুক্রবার সকালে এ ধর্মঘট শুরু হয়।
জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী জানান, দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের নামে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ১৫টি ট্রাক, পাঁচটি বাস, তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও দুটি মাইক্রোবাস ভাঙচুর করা হয়। এতে শ্রমিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এ কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য যানবাহন চালানো থেকে বিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জ থেকে দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী জানিয়েছেন, যাত্রী-চালক ও যানবাহনের নিরাপত্তার দাবিতে সুনামগঞ্জেও অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ রেখেছে সুনামগঞ্জ পরিবহন মালিক সমিতি।
ভোর থেকে অন্য জায়গা থেকেও কোনো পরিবহন সুনামগঞ্জে আসেনি। এদিকে, ভোর থেকে সব ধরনের যানচলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে বের হওয়া যাত্রীরা।
সুনামগঞ্জ পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বর্তমানে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। সেইসঙ্গে চালক ও পরিবহনেরও কোনো নিরাপত্তা নেই। তাই আমরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ থেকে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার যাত্রীসহ সব ধরনের পরিবহন চলাচল চালু হবে।’
নাটোর থেকে হালিম খান জানিয়েছেন, চালক ও পরিবহনের নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে নাটোর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পরিবহন মালিক শ্রমিকরা।
এ বিষয়ে নাটোর বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
নাটোর বাস টার্মিনালের কাউন্টার মাস্টার কোরবান আলী জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে মালিক-শ্রমিকরা বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে।
এদিকে, হঠাৎ করে বাস চলাচল বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে দূর পাল্লার যাত্রীরা টার্মিনালে এসে বসে থেকেও কূলকিনারা পাচ্ছেন না।
জয়পুরহাট থেকে শাহজাহান সিরাজ মিঠু জানিয়েছেন, এদিকে উত্তরবঙ্গের জয়পুরহাট জেলায় দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসসহ (কোচ) ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এর ফলে আজ ভোর থেকে জয়পুরহাট থেকে ঢাকাগামী কোনো পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি বাসও চলাচল করেনি। অপরদিকে, ঢাকা থেকেও কোনো বাস জয়পুরহাটে আসছে না। তবে, আজ এখানকার কোনো সড়কে শিক্ষার্থীদের অবরোধ কিংবা লাইসেন্স (কাগজপত্র) চেক করতে দেখা যায়নি।
এদিকে, কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে জয়পুরহাট থেকে ঢাকার কোচসহ দূরপাল্লার ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে জয়পুরহাট জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রফিক জানান, সড়কে যানবাহন ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঢাকার সব বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
গাজীপুর থেকে নাসির আহমেদ জানিয়েছেন, এদিকে, গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল মহাসড়কে গণপরিবহনের সংকট দেখা দিয়েছে। গতকাল থেকেই এই পরিবহন সংকট দেখা দেয়। ফলে যাত্রীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। গন্তব্যে যেতে বিকল্প ব্যবস্থায় বেশি ভাড়ায় যেতে হচ্ছে তাদের। অনেকে হেঁটেই রওনা দিচ্ছেন।
যাত্রীদের এই ভোগান্তির জন্য পরিবহন মালিক শ্রমিকদের দায়ী করেছেন সাধারণ যাত্রীরা। তাঁদের দাবি, সরকার ইচ্ছে করলেই এই সংকট দূর করতে পারে। তবে অনেকে এই সংকটকে কোনো কষ্টই মনে করছেন না। তারা বলেন, ‘ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি সরকারের মেনে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
বরিশাল থেকে আকতার ফারুক শাহিন জানিয়েছেন, এদিকে নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতিবাদে বরিশাল থেকে দূরপাল্লার রুটে সব বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানা যায়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরিশাল জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আফতাব আহম্মেদ।
বরিশাল জেলা বাস মালিক সমিতি জানায়, মাদারীপুর বাস মালিক সমিতির বাধার কারণে বরিশালে ঢাকা, যশোর, রাজশাহীসহ দূরপাল্লার কোনো বাস আসতে পারছে না। এ ছাড়া বরিশাল থেকে কোনো বাস ওইসব রুটে যেতে পারছে না।
এদিকে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আজ শুক্রবার বরিশালে কোনো কর্মসূচি করেনি শিক্ষার্থীরা।
কুষ্টিয়া থেকে সাবিনা ইয়াসমিন শ্যামলী জানিয়েছেন, আজ সকাল থেকে কুষ্টিয়ার মজমপুর গেট থেকে ঢাকাগামী কোনো পরিবহন ছেড়ে যায়নি। তবে সংখ্যায় কম হলেও কুষ্টিয়া থেকে ঝিনাইদহ সড়কে কিছু যাত্রীবাহী পরিবহন চলাচল করতে দেখা গেছে। বাস মালিকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের অনীহা ও নিরাপত্তার স্বার্থে দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেলা বাস মিনিবাস ও মাইক্রোবাস মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাহাবুল আলম বলেন, ‘শ্রমিক ফেডারেশনের নির্দেশে সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে সকালের দিকে কুষ্টিয়া থেকে গড়াই, রূপসা পরিবহন খুলনার উদ্দেশে রওনা হয়ে ঝিনাইদহ থেকে ফেরত আসছে। কিছু সময় পর থেকে সেটিও বন্ধ হয়ে যাবে।’
ফলে পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীরা ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে। তবে আজ কুষ্টিয়ায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তেমন একটা মাঠে দেখা যায়নি।
ফরিদপুর থেকে সঞ্জিব দাস জানিয়েছেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দ্বিতীয় দিনের মতো ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে মালিক সমিতি ও শ্রমিকরা।
এতে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। তবে মাঝে মধ্যে দু-একটি বাস ঢাকার দিকে ছেড়ে যাচ্ছে। আজ শুক্রবার ফরিদপুর পৌর বাস টার্মিনালে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে বাস না পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন অনেকেই। কেউ কেউ বিকল্প পথে গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন। কাউকে আবার বাস ছাড়ার আশায় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
যাত্রীরা বলছেন, সকাল থেকে বাসস্ট্যান্ডে এসে দুপুর পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করছেন। ঢাকা যাওয়ার কোনো উপায় পাচ্ছেন না। এদিকে, ফরিদপুর বাস কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতারা বলছেন, ‘নিরাপত্তার কারণেই আমরা বাস ছাড়ছি না।’
সিলেট থেকে মঈনুল হক বুলবুল জানিয়েছেন, একই ঘটনায় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সিলেট থেকে দূরপাল্লার সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। আজ থেকে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই এ বাস চলাচল বন্ধ করে দেন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।
যাত্রীরা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই কমতে থাকে বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাওয়া বাসের সংখ্যা। সকালে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই পুরোপুরি বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বাস টার্মিনালে এসে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।
বাস চলাচল বন্ধের কারণ জানতে চাইলে সিলেট বাস মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের কোষাধ্যক্ষ আবদুল হক মানিক বলেন, ‘রাস্তায় বের হলেই শিক্ষার্থীরা ইচ্ছামতো বাস ভাঙচুর করছে। এতে মালিকরা লাখ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। তাই নিরাপত্তার অভাবে শুক্রবার ঢাকামুখী বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পাশাপাশি সিলেট আঞ্চলিক সড়কেও সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।’
এদিকে, পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, বাসচালকদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের উদ্যোগের প্রতিবাদে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। রাস্তায় চলাচলের সময় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। চালকরা এ জন্য দায়ী নয়।