‘বইনডা যে মইরা গেল গা’, সহপাঠীকে হারিয়ে আর্তনাদ
‘একটা কথা বলি? বইনডা মইরা গেছে। বইনডা মইরা গেছে গা। বইনডার পরীক্ষাটার পরে বিয়া হইতো। বইনডা যে মইরা গেল গা !’
কথাগুলো বলছিলেন শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এক ছাত্র। গতকাল রোববার রাজধানীর কুর্মিটোলার এয়ারপোর্ট রোডে বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মধ্যে ছিলেন তাঁর সহপাঠী-বন্ধুও। সহপাঠীকে হারিয়ে আর্তনাদ করছিল সে।
পাশেই বাস ভাঙতে নিষেধ করছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আছেন সাংবাদিকরাও। এ সময় পুলিশ-সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কান্নারত এই শিক্ষার্থী। এরপর এই কথোপকথনের ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইসবুকে।
এ সময় পুলিশ বলছিলেন, ‘অনেক হইছে। হেরা তো কোনো অপরাধ করে নাই বাবা। অনেক হইছে বাবা। অনেক ভাঙছ।’
শিক্ষার্থী বলে ওঠে, ‘বাধা দিয়েন না। বাধা দিয়েন না। একটা কথা বলি? বইনডা মইরা গেছে। বইনডা মইরা গেছে গা। বইনডার পরীক্ষাটার পরে বিয়া হইত। বইনডা যে মইরা গেল গা। নিজের ফ্রেন্ড, ১০টা বছর একটা স্কুলে কাটাইছি। কলেজটা ছুটি হইব।কলেজটা ছুটি হইব তো ওস্তাদ। কলেজটা ছুটি হইয়া গেছে। আপনে আমার বাপের বয়সী। আপনেরে চাচা ডাকতাছি। আমারে বাধা দিয়েন না। মাফ চাই আপনার কাছে, প্লিজ। এই রকম কইরেন না। থামতে বইলেন না। সবকিছু কন করতে রাজি আছি। আপনে যদি কন জেলে যাইতে কোনো সমস্যা নাই। জেলে যামু।’
এ সময় পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এইডা কি বলো? জেলে যাইবা কেন?’
কান্নারত শিক্ষার্থী বলেন, ‘এইডাই তো কথা। আপনা গো পুলিশের আর কী কাজ? কী কাজ বলেন। আপনারা বলেন, ঐখানে একটা বাসও থামায় না। স্টুডেন্ট দেখলেই ওদের পিকআপ বাইড়া যায়গা। কিয়ের এত পিকআপ? আমরা পড়ালেখা করতাছি না? কিল্লেগা আমগোর সাথে রাফ বিহ্যাভ করতেছে উনারা?’
এ সময় সাংবাদিকরা এগিয়ে এলে কাঁদতে কাঁদতে এই শিক্ষার্থী কিছু প্রশ্ন করেন?
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘কলেজের বদনাম হইব? আপনে কন কলেজের বদনাম হইব? কলেজ ছুটি হইছে। কুর্মিটোলার ওইখানে রেডিসনের ঠিক অপজিট সাইডে আমরা দাঁড়াইয়া আছি। আর ওইখান থেকে টঙ্গীর যারা যাত্রী, যারা সিটিং সার্ভিসে যেতে চায়, অনেক আরামে যাওয়ার জন্য সিটিং সার্ভিস ইউজ করে। আচ্ছা ভালো কথা। এই সিটিং সার্ভিস যদি, আর তো বাস নাই আমাদের। আমাদের যদি অন্য বাস থাকত, আমরা অন্য বাসে যাইতাম। আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না। ঘটনা হইল, বাস আমাদের দেখলে কেন থামায় না? এটা নিয়া রমিজ উদ্দিন স্কুলে লাস্ট আরো পাঁচ বছর আগে, একজন স্টুডেন্ট মারা গেছে। তারপর সরাসরি ওবায়দুল কাদেরের কাছে গিয়া বলছে যে, আমাদের একটা বাসের ব্যবস্থা কইরা দেন। বাসের ব্যবস্থা কইরা দিছে। ঠিক আছে। আমরা যে এই যাত্রীগুলা যাই। আমাদের কোনো পাত্তাই দেয় না। আমরা কি স্টুডেন্ট না? আমরা স্টুডেন্ট মানে কি কলঙ্ক। আমরা কি সন্ত্রাসী? কোনো সন্ত্রাসী না।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘পাঁচজনের খুব খারাপ অবস্থা। দুজন স্পট ডেড। দুজন শিউর স্পট ডেড। পাঁচজনের মধ্যে দুজনের খুব সিরিয়াস অবস্থা। এর মধ্যে, আল্লাহরে আল্লাহরে। এর মধ্যে এখনো কনফিউজড আছে যে, বাঁচবে কি না। আমার একজন ক্লাসমেট সিএমএইচে ভর্তি আছে। মারা গেছে কি না জানি না। আমাদের কেউ যাইতেও দিতেছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার ফ্রেন্ড হচ্ছে তিনজন। এর মধ্যে দুজন হচ্ছে আমার বোন। আর একটা হচ্ছে, একদম ছোটো থাইকা আমরা একসাথে পড়তেছি, ও। আমরা যাব। আমাদের বাসা হচ্ছে নতুন বাজার। তো যখন এখান থেকে যায়, যাওয়ার পথে, উনারা বাসটা থামায় না। আমাদের বাস হচ্ছে চারটা। জাবালে নূর বাসে উঠতে চাইছিল, জাবালে নূর বাসে উঠছে, কয়েকজন উঠছে। ওরা না, বাসটা থামা ভাই তোরা। যাত্রীরারে উঠতে দে। ইয়ং দেইখা কি আমরা দৌড়ায়ায়া উঠমু? কেন দৌড়াইয়া উঠমু? আমাদের কি কোনো অধিকার নাই? অনেকক্ষণ ধইরা বলতেছে, এই থামা এই থামা। থামাইছে, যখন যাত্রীরা উঠবে, তখন পিছন থেকে বলাকা এসে ওভারটেকিং করে, যারা উঠতে পারছে, তারা তো উঠছে। যারা উঠতে পারে নাই, তাদের আল্লাহ জান্নাত দেক। মাতাল অবস্থা। বাংলাদেশের মানুষরে কিল্লিগা যে, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়। আমার মনডা চাইতাছে এহন গাইল্লাই। গাইল্লাইতাছি না। কারণ কি, আমার কলেজের সম্মান আছে। আমি চাই না, আমার কারণে আমার কলেজের বদনাম হোক।’
গতকাল রাজধানীর কুর্মিটোলার এয়ারপোর্ট রোডে বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন চারজন। নিহত শিক্ষার্থীরা হলো শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী দিয়া খানম মীম ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম।
এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়, শতাধিক বাস ভাঙচুর করে। বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মিরপুর-উত্তরা রোডের জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস মিরপুর থেকে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে আসছিল। এ সময় ফ্লাইওভারের শেষ দিকে, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল একদল শিক্ষার্থী। বাসটি ফ্লাইওভার থেকে নেমেই দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। আহত হয় আরো বেশ কয়েকজন।