পুলিশের পরিচয় দেওয়াই কাল হলো মামুনের
রহমত উল্লাহকে নিজের জন্মদিনে আমন্ত্রণ জানান আফরিন। তিনি টেলিভিশনের ‘ক্রাইম সিরিয়ালে’ অভিনয় করেন। আফরিন জানান ‘বার্থ ডে’ পার্টিতে তাঁর কয়েকজন বান্ধবী ছাড়া কেউ থাকবে না। রহমত মামুনকে নিয়ে সেখানে যান। সেখানেই তিন চারজন যুবক নিজেদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয় দিয়ে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করার চেষ্টা করেন।
তখনই মামুন নিজের পরিচয়পত্র বের করে দেখান। তিনি মামুন এমরান খান, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক। ওই পরিচয়ই কাল হলো মামুনের। দুর্বৃত্তরা ভয় পেয়ে মারধর করে মেরেই ফেলে মামুনকে।
আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন।
এসবির পরিদর্শক মামুন হত্যার ঘটনায় গতকাল বুধবার রাতে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আটককৃতরা হলেন, মিজান শেখ, মেহরেুন্নেছা স্বর্ণা ওরফে আফরিন বা আন্নাফি, সুমাইয়া আক্তার ওরফে কেয়া ও ফারিয়া বিনতে মীম। রাজধানীর বাড্ডা ও হাজারীবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
আব্দুল বাতেন জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই হত্যার সঙ্গে অন্যতম তিনজন আসামি স্বপন, দিদার ও আতিককে ধরার চেষ্টা চলছে। এদের মধ্যে মিজান পুলিশের একজন সাবেক বরখাস্তকৃত পরিদর্শক, দিদার, স্বপন ও আতিক কোনো এক সময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। তাঁদের ধরতে পারলেই এ হত্যার সব তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন ডিবির এই কর্মকর্তা। তবে এই ঘটনায় গতকাল বুধবার মামুনের বন্ধু রহমত আদালতে ১৪৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্যদেরও আদালতে তোলা হবে বলে জানান তিনি।
গ্রেপ্তারকৃতরা মামুনকে কীভাবে এবং কেন হত্যা করেছে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বর্ণনা করেছেন।
‘মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল না’
আব্দুল বাতেন জানান, মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না। তাঁরা মূলত মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করতে চেয়েছিলেন। ‘ব্ল্যাক মেইলে’র পর তাঁরা রহমতের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু রহমতের সঙ্গে মামুন ঘটনাস্থলে যাওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
সেখানে মামুন পুলিশের কর্মকর্তা পরচিয় দিলে তারা বিপদে পড়ার ভয়েই তাকে মারধর করে। ওই মারধরই মারা যান মামুন। পরের দিন সকালের দিকে তাঁরা গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানা এলাকায় একটি বনে মামুনের লাশটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে মামুনের মুখটি বিকৃত করে দেন তাঁরা।
মামুনের লাশ কোথাও ফেলে দেবে নাকি আগুনে পুড়ে ছাই করে দেবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন তাঁরা।
‘বার্থ ডে পার্টি’তে আমন্ত্রণ
আব্দুল বাতেন জানান, নিহত মামুনের বন্ধু রহমত, মডেল অভিনেত্রী আফরিনসহ আরো কয়েকজন কয়েক বছর ধরে টিভির একাধিক ‘ক্রাইম সিরিয়াল গোয়েন্দা’ নাটকে অভিনয় করছিলেন। ওই সুবাদে তাঁদের মধ্যে পরিচয় ছিল। বছর খানেক আগেও রহমত ও আফরিন একটি নাটকে অভিনয় করেন। ঘটনার দিন রহমতকে হঠাৎ করেই ‘ক্রাইম সিরিয়ালের অভিনেত্রী’ আফরিন ফোন করে জানান তাঁর আজ ‘বার্থডে পার্টি’। সেখানে তাঁর তিন-চারজন বান্ধবী ছাড়া আর কেউই থাকবে না। এ কথা শোনার পর রহমত তাঁর বন্ধু মামুনকে ফোন করেন এবং সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। মামুনও রাজি হন। বনানীর এক বাসায় ছিল ওই আয়োজন। মামুন নিজের মোটরসাইকেল ও রহমত প্রাইভেটকারে করে রওনা হন। ওই বাসায় প্রবেশের সময় তাঁরা আফরিনকে ফোন দেন। আফরিন তাঁদের ফোন ধরেন।
বাসার দ্বিতীয় তলায় প্রবেশের খানিক পরই তিন-চারজন যু্বক এসে বলে, তোরা (মামুন ও রহমত) খারাপ ও এই মেয়েরাও খারাপ। তোদের ছবি তুলে পত্রিকায় দিয়ে দেব। এ কথা শোনার পর মামুন বলে আপনারা কারা। তখন ওই চার যুবক (মিজান, দিদার, স্বপন ও আতিক) নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দেন। এ সময় মামুনও নিজেকে পুলিশের সদস্য বলে তাঁর পরিচয়পত্র দেখান। এতে তাদের মাথা বিগড়ে যায়। তারা মামুন ও রহমতের মুখে কসটেপ লাগিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে। পরে তারা মামুনকে ব্যাপক মারধরও করে।
বন্ধুর মাইক্রোবাসেই নেওয়া হয় লাশ
রহমত দেখতে পান মামুন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানে তিনি মারা যান। মামুন মারা যাওয়ার দৃশ্য দেখে ওই চার যুবক ভয় পান এবং তাঁরা লাশটি কীভাবে গুম করবে তার পরিকল্পনা করতে থাকেন। মামুন যখন মারা যান তখন রাত ১২টা। পরের দিন তাঁরা ভোরে রহমতের মাইক্রোবাসে করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে গাজীপুরের দিকে রওনা হন। মাইক্রোবাসটি চালান রহমত নিজেই। আর মাইক্রোবাসে ছিলেন ওই বাসার ম্যানেজার রবিউল, মিজান ও রহমতসহ পাঁচজন। গাজীপুর যাওয়া ও লাশ গুম করার পরিকল্পনায় ছিলেন মিজান শেখ।
আব্দুল বাতেন আরো জানান, তাঁরা মামুনের লাশটি মাইক্রোবাসে নেওয়ার পর পথে রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঢুকে নাস্তা খান। পরে পেট্রল নিয়ে কালীগঞ্জের দিকে রওনা হন এবং উলুখোলা জায়গার একটি জঙ্গলে লাশটি ফেলে দেওয়ার পর তা পুঁড়িয়ে দিয়ে তারা ঢাকায় চলে আসেন।
এর আগে ৮ জুলাই সবুজবাগ থানায় মামুনের পরিবার তাঁর নিখোঁজের বিষয়টি উল্লেখ করে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। বিষয়টি তদন্ত করছিল পুলিশের কয়েকটি টিম।
লাশ ফেলে ঢাকার আসার পরই রহমতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে রহমত আফরিন, মিজান, দিদার, স্বপন ও আতিকের সম্পৃক্ত থাকার কথা জানান। পরে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।