ঈদযাত্রায় ঝরেছে ৪০৫ প্রাণ
এবারের ঈদুল ফিতরে সারা দেশে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৯ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন এক হাজার ২৬৫ জন। তবে একই সময়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে ৩৩৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে ৪০৫ জন নিহত হয়েছেন। আর এক হাজার ২৭৪ জন আহত হয়েছেন। ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি জাতীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যাদি পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করে। গত চার বছরের মতো আজ শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
ঈদযাত্রা শুরুর দিন ১১ জুন থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা, অর্থাৎ ২৩ জুন পর্যন্ত মোট ১৩ দিনের দুর্ঘটনার ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সংগঠনের মহাসচিব। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘এবারের ঈদের আগে যাত্রাপথে সকল তদারকি সংস্থার সক্রিয় অবস্থানের কারণে ঈদযাত্রা খানিকটা স্বস্তিদায়ক হলেও ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার পথে তদারকি না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।’
সড়কপথে ৩৩৯ জন নিহতের বাইরে ‘একই সময়ে নৌপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত, ৫৫ জন নিখোঁজ ও নয়জন আহত হয়েছেন। রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে ৩৫ জন, ট্রেনের ধাক্কায় চারজন ও ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে দুজনসহ মোট ৪১ জন নিহত হয়েছেন’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার হার ১৫.২৮ ভাগ’
দুর্ঘটনার যানবাহনভিত্তিক পরিসংখ্যান উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস ও ট্রাকে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে বাসে আর ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে দুর্ঘটনার হার ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার হার। সাম্প্রতিক সময়ে সড়কে প্রাধান্য বিস্তারকারী দুই চাকার এই যানে দুর্ঘটনার হার ১৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এ ছাড়া ১২ দশমিক ২২ শতাংশ নছিমন-করিমন, ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ অটোরিকশা, ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস এবং ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ অনান্য যানবাহনের দুর্ঘটনা ছিল।
দুর্ঘটনার প্রকারের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মোট সংগঠিত দুর্ঘটনার ৩৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩২ দশমিক ৭২ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়া, ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা, ১ দশমিক ১০ শতাংশ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে, শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে ও ১৮ দশমিক ২০ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার কারণ
যাত্রী কল্যাণ সমিতি দুর্ঘটনার পর্যবেক্ষণ করে গিয়ে দেখেছে, এসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অন্তত আটটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে দীর্ঘ যাত্রায় চালকদের বিশ্রাম না পাওয়ার পাশাপাশি সড়কের বেহাল দশাও কথাও বলা হয়েছে।
গত ২৫ জুন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দূরপাল্লার যানে বিকল্প চালক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া পরিবহনের চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, রাস্তার মাঝে চালকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা, সিগন্যাল দিয়ে পারাপার করা ও সিট বেল্ট পরানো নিশ্চিত করার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত নিয়ম হচ্ছে, দূরের যাত্রায় একজন চালক যেন একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালান।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন। বিরতিহীন/ বিশ্রামহীন ভাবে যানবাহন চালানো। অদক্ষ চালক ও হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো। মহাসড়কে অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, নছিমন-করিমন ও মোটরসাইকেল অবাধে চলাচল। মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা। বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো। সড়ক-মহাসড়কে ফুটপাত না থাকা। সড়ক-মহাসড়কে বেহাল দশা এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ
দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। প্রশিক্ষিত চালক গড়ে তোলা জন্য জাতীয় পর্যায়ে সরকারিভাবে ‘চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ গড়ে তোলা। নিয়মিত রাস্তার রোড সেফটি অডিট করা।
ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করার আহ্বানও জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এ ছাড়া ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে মানসম্মত পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা। মহাসড়কে ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
মহাসড়কে নছিমন-করিমন, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা বন্ধে সরকারের সিদ্ধান্ত শতভাগ বাস্তবায়ন করা। ভাঙাচোড়া রাস্তাঘাট মেরামত করা। ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া।
জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ফুটপাত, আন্ডারপাস, ওভারপাস তৈরি করে পথচারীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা করারও সুপারিশ করা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।