কানাডার নির্বাচনে ডলির বিজয়, মৌলভীবাজারে আনন্দ
কানাডার প্রাদেশিক নির্বাচনে এমপিপি (প্রাদেশিক পার্লামেন্ট সদস্য) নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছেন ডলি বেগম। তার এ বিজয়ের খবর মৌলভীবাজারে পৌঁছালে আনন্দে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে সবাই।
গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনে ডলির বিজয়ের খবর শুক্রবার দুপুর থেকে লোকমুখে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ায়। দেশ ও প্রবাসে থাকা মৌলভীবাজারের বাসিন্দারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে উষ্ণ অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডলি এই প্রথম কোনো ব্যক্তি, যিনি কানাডার প্রাদেশিক নির্বাচনে জনগণের বিপুল ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।
ফেসবুকে অনেকেই ‘ডলি দেশের গর্ব, আমাদের অহংকার’ এমন অনুপ্রেরণামূলক লেখা ও তাঁর ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস দেন। ডলিকে নিয়ে এমন সব লেখা ও তাঁর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এখন ফেসবুকে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। নির্বাচনের আগে থেকেই আত্মীয়স্বজন ও কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডলি বিজয়ী হবেন প্রত্যাশা করেছিলেন। তাঁর বিজয়ে আনন্দে উদ্বেলিত সবাই।
কানাডা প্রবাসী জেলার বড়লেখা উপজেলার আজিমগঞ্জ সালদিঘা বড়বাড়ির বাসিন্দা কামরুল ইসলাম, মো. আশরফ তানিম ও মো. আরিফ তায়েফ দুপুরে বলেন, ডলির বিনয়ী স্বভাব, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দল ও কমিউনিটির প্রতি তাঁর উদার আন্তরিকতা তাঁকে বিজয়ী করেছে। তাঁর বিজয়ে সে দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলো। এতে প্রবাসে থাকা নতুন প্রজন্ম সে দেশের স্থানীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে উৎসাহবোধ করবেন। আগামীতে কানাডার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের অবস্থান আরো শক্ত হবে।
জানা যায়, এর আগে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে এ জেলার পাঁচজন প্রবাসী বাংলাদেশি সে দেশের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। একের পর এক দেশে এ জেলার বাসিন্দা প্রবাসীরা ওই দেশগুলোর জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ায় স্থানীয়রা আনন্দিত।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দা সায়রা মহসীন, মৌলভীবাজার পৌর মেয়র মো. ফজলুর রহমান, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবীদ ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব, সাবেক ব্রিটিশ কাউন্সিলর ও বিশিষ্ট শিল্পপতি এম এ রহিম সিআইপি, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বকসী মিছবাহ উর রহমান বলেন, ‘প্রবাসে মৌলভীবাজারের বাসিন্দারা যেভাবে স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন, তাতে দেশবাসীর সাথে আমরাও আনন্দিত ও গর্বিত। ডলিসহ অন্যদের এমন সাফল্যে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। আমারা জেলাবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে অভিনন্দন জানাই।’
জানা যায়, ডলি বেগম কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের পার্লামেন্ট নির্বাচনে টরন্টো এলাকার স্কারবোরো সাউথ ওয়েস্ট আসন থেকে এমপিপি নির্বাচিত হন। গত ৭ জুন অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে তিনি নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) মনোনয়নে নির্বাচন করেন। এর আগে কোনো বাঙালি কানাডার নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেননি।
ডলি বেগম মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের বাজরাকোনা গ্রামের মো. রাজা মিয়া ও জবা বেগমের সন্তান। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে ডলি বেগম বড়। রাজা মিয়া তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজো। ডলির বড় চাচা মো. বাদশা মিয়া সপরিবারে লন্ডনে থাকেন। আর ছোট চাচা দেশে থাকেন। তাঁর দাদা মো. সোনা মিয়া। ডলি বেগমের নানা বাড়ি রাজনগর উপজেলার হরিনাচংগ্রামে।
১৯৯৮ সালে ডলি তাঁর বাবা-মার সঙ্গে কানাডায় পাড়ি জমান। অবশ্য তাঁর বাবা এর আগে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। ডলি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ উচ্চ বিদ্যালয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায় প্রবাস জীবনে চলে যান। সেখানে কানাডার গর্ডন এ ব্রাউন মিডল স্কুল ও ডব্লিউ এ পোর্টার কলিজিয়েট ইনস্টিটিউট কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো (সেন্ট জর্জ) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর লন্ডনের বিশ্বখ্যাত ইউসিএল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন ডলি। তিনি স্কুলজীবন থেকে নানা বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। বলতে গেলে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাই ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের কল্যাণেও নিবেদিত হন। অতি অল্প সময়ে সবার পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। তিনি স্কারবোরো হেলথ এলায়েন্সের কো-চেয়ারম্যান হিসেবেও কাজ করেছেন। কমিউনিটির কল্যাণেও নিবেদিত ছিলেন তিনি। ডলি বেগমের নির্বাচনী প্রচারণার সময় স্লোগান ছিল ‘আমাকে নির্বাচিত করুন, আমি আপনাদের আশাহত করব না।’
ডলির এই বিজয়ে কানাডায় বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের তরুণদের প্রেরণা জোগাবে বলেই মনে করেন কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা। ডলি প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির গ্রে এলিয়েসকে প্রায় ছয় হাজার ভোটের ব্যবধানে হারান। ডলির পান ১৯ হাজার ৭৫১ ভোট। ডলি নির্বাচনে দাঁড়ানোর পর কানাডায় বসবাসরত বাঙালিদের অকুণ্ঠ সমর্থন পান। ভোটের আগে ভোটারদের উদ্দেশে ডলি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদেরই একজন, আপনাদেরই মতো জীবনযুদ্ধের প্রতি পদে হাজারো বাধাবিপত্তি আর অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন। তাই আমি নির্বাচিত হওয়া হবে আমাদের মতো হাজারো মানুষের নিজেদের বিজয়।’ তিনি সে দেশের তরুণ সমাজকে মাদকমুক্ত করে রাজনীতি ও জনকল্যাণে নিবেদিত হতে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছেন। তা ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতেও তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
শুক্রবার সকাল থেকে মৌলভীবাজারসহ মনুমুখ বাজরাকোনা গ্রামে চলছে উৎসবের আমেজ। তারা ডলির এমন বিজয়ে আনন্দে উদ্বেলিত। ডলি বেগমের ছোট চাচা মুনমুখ ইউনিয়নের বাজরাকোনার বাসিন্দা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পরিচালক মো. আব্দুস শহিদ বলেন, ডলি বেগম কানাডার জনপ্রনিধি নির্বাচিত হওয়ায় তার দল, দেশ ও প্রবাসীদের মতো তিনিও আনন্দিত। এই প্রথম বাংলাদেশি একজন নারীকে সে দেশের এমপিপি নির্বাচিত করার সম্মানিত ভোটারদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ডলি, তার বাবা-মা ও ভাই প্রায়ই দেশে আসেন। দেশে এলে তাঁরা গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করেন। ডলিরও জন্মমাটি ও দেশের প্রতি যথেষ্ট টান রয়েছে।
ডলি বেগমের দাদা মুনমুখ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সুজন মিয়া জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ডলির বাবা রাজা মিয়া সে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার আহত হয়ে দীর্ঘদিন বিছানাগত। সে কারণে পারিবারিকভাবে অনেক কঠিন সময় অতিক্রম করতে হয়েছে ডলির। সে সময় একমাত্র ছোট ভাই মহসিন ও পরিবারের হাল ধরেছেন ডলি। তিনি বলেন, তাঁর সততা ও উদ্যম, দৃঢ় মনোবল ও সবার দোয়ায় তিনি এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন। তিনি তার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান।