পতাকা উন্মাদনায় ফুটবল বিশ্বকাপ
বাংলাদেশে ক্রিকেটের কাছে ফুটবল তার জনপ্রিয়তা হারালেও বিশ্বকাপ সামনে রেখে হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে গেছে দৃশ্যপট। বিশ্বকাপ দরজায় কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে ফুটবলীয় উন্মাদনা। চলছে পছন্দের প্রিয় ফুটবল দলের পতাকা ওড়ানোর উৎসব। আর এসবের সঙ্গে কথার লড়াই তো আছেই।
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, রাস্তার মোড়, বাড়ির ছাদ, বাসার ব্যালকনি, যানবাহন কিংবা অফিসে জনপ্রিয় ফুটবল দেশের পতাকা ওড়ানো দেখেই সেই উন্মাদনা আঁচ করা যায়। শহরের অধিকাংশ মোড়ে বাসাবাড়িতে, রিকশায়, বাসে কিংবা মোটরসাইকেলে পতপত করে উড়ছে বিভিন্ন দেশের পতাকা।
এসব পতাকা কোথাও ছোট, কোথাও মাঝারি, আবার কোথাও বড় আকারে উড়ছে। বিক্রির জন্য এসব পতাকা নিয়ে আবার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন হকাররা। সেই পতাকা কিনে ফুটবলপ্রেমীরা ওড়াচ্ছেন মন ভরে। বিষয়টা এমন, যিনি যত বড় যে পতাকা ওড়াতে পারেন, তিনি তত বড় সমর্থক। আর পতাকা ওড়ানো নিয়েও কখনো কখনো সৃষ্টি হয় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনারও।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফুটবলপ্রেমীদের ভাবনা ও ফুটবল উন্মাদনার এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুর রহমান হলের ফটকে দেখা যায় আর্জেন্টিনার একটি বড় পতাকা এবং জার্মানির একটি বড় পতাকাসহ কয়েকটি ছোট পতাকা উড়ছে। সেখানে এনটিভি অনলাইনের কথা হয় ওই হলে থাকা সমাজকল্যাণ বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল হুদার সঙ্গে।
নাজমুল হুদা বলেন, ‘এই হলে আর্জেন্টিনার সমর্থক বেশি। আমি নিজেও আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করি। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে জার্মানি। এর পরে ব্রাজিল ও স্পেনের অবস্থান। তবে হলের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা আর্জেন্টিনা আর জার্মানির সমর্থক। তাই হলের বাইরে অন্য দেশের পতাকা নেই। অবশ্য হলের ভেতরে সব দলের পতাকাই আছে।’
পান্থপথের একটি বাসার মালিক গোলাম রব্বানী ব্রাজিলের বড় পতাকা ঝুলিয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে পতাকাটি ঝুলিয়েছি। বিশ্বকাপ চলে এসেছে আর পতাকা উড়বে না, তা কী হয়? খেলা মানে আনন্দ, বলতে পারেন এক ধরনের উৎসব। আমরা শুধু সেই উৎসবের অংশগ্রহণকারী। বিশ্বকাপ নিয়ে চারদিকে যেভাবে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছে, তা আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।’
পতাকা ওড়ানো নিয়ে বিবাদ
মিরপুরের কাজীপাড়ার ৬ নম্বর রোডের একটি বাড়ির ছাদে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা ওড়ানোকে কেন্দ্র করে গত বুধবার দুই সমর্থকের মধ্যে বাধে বিপত্তি। আর্জেন্টিনার সমর্থক মো. দিদার আহম্মদ বাড়ির ছাদের পানির ট্যাংকির ওপরে বাঁশের সঙ্গে পতাকা উড়িয়েছিলেন। একই ছাদে ব্রাজিলের পতাকা টাঙানো ছিল ওই পতাকার নিচে।
আর্জেন্টিনার পতাকা ওপরে দেখে ব্রাজিলের সমর্থক মোখলেসুর রহমান বৃহস্পতিবার ট্যাংকির ওপরে আবারও উঁচু করে পতাকা টাঙান। পাল্টাপাল্টি পতাকা টাঙানো নিয়ে তাঁদের দুজনের ভেতরে কথাকাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে হাতাহাতিও হয়। পরে দুটি পতাকাই নামিয়ে দেন বাড়ির মালিক।
ঘটনা জানার পরে শনিবার সকালে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় বাড়িটির মালিক আমজাদ চৌধুরীর। তিনি বলেন, ‘খেলা নিয়ে কী যে কাণ্ড শুরু হয়েছে। খেলা নিয়ে যদি মারামারি হয়, তাহলে বিষয়টা কেমন না? আমিও আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করি। তাই বলে কি আমি আমার বিপরীত দলের সাপোর্টারকে ধরে পেটাব? মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের।’
এ রকম আরো অনেক ফুটবলপ্রেমীর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। খেলা নিয়ে তাঁরাও একই ধরনের উন্মাদনার কথা জানান। তাঁদের ভেতরে একজন শফিক রহমান। তিনি বলেন, ‘খেলা হলো আনন্দের খোরাক। খেলা নিয়ে সাধারণত কুতর্ক করি আমরা। আর সেটার জন্য কখনো কখনো কথাকাটাকাটির পর্যায়েও চলে যাই।’
শফিক বলেন, ‘ফেসবুকে যদি আপনি থাকেন তাহলে জানার কথা যে কী নোংরা মানসিকতা কাদা চালাচালি হয় সেখানে। চলে খোঁচা মেরে কথাবার্তা। একজন খেলোয়াড় ভালো জেনেও আমরা তাঁকে খারাপ বলি। এসব কখনো কখনো ব্যক্তিগত আক্রোশেও রূপ নেয়। সব সময় আমাদের মাথায় রাখা উচিত এটি শুধুই একটি খেলা। আনন্দ করতে গিয়ে যেন সংঘাত না বাধে।’
যেভাবে খেলা দেখা হতো
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী স্বাধীন চৌধুরী বলেন, 'আসলে খুব ছোটবেলায় দেখতাম আব্বা কোলে করে খেলা দেখাতেন উঠানে বসে। গ্রামের বাড়িতে তখন শুধু আমাদের বাড়িতে টিভি ছিল। পাটি বিছিয়ে অনেক লোক একসঙ্গে খেলা দেখতেন। আব্বা ছোটবেলা থেকেই জার্সি কিনে দিতেন আমাকে। বেশ শিক্ষিত লোক, স্মার্ট। আব্বা আর্জেন্টিনারর সমর্থক ছিলেন। তখন দেখতাম কী উল্লাস। রাত ভরে খেলা দেখতেন। ম্যারাডোনার কথা শুনতে শুনতে আমিও আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করা শুরু করি।'
স্বাধীন চৌধুরী আরো বলেন, ‘এখন সবার বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন। কেউ আর কারো বাড়ি যায় না খেলা দেখতে। একা একা দেখে। আগের মতো সেই উল্লাস ভরা চিৎকার আর শোনা যায় না। তখন তো খেলার আবেশ বারো মাসই ছিল। এখন অবশ্য ক্রিকেট বারো মাসের খেলা হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে এখন আপনি বিশ্ব ক্রিকেটের প্রতিনিধিই বলতে পারেন। বাংলাদেশ তো ভীষণ মাত্রায় ক্রিকেটপ্রেমী। এখন আর আসলে বিশ্বকাপ ছাড়া ফুটবল খেলা দেখা হয় না। ক্লাবও মাঝে মাঝে দেখা হয়। তবে গত কিছুদিন ধরে যে উন্মাদনা। খারাপ লাগছে না, ভালোই। খেলাটাকে উপভোগ করতে চাই। দেখা যাক কী হয়।’
কী বলছেন হকার
কারওয়ান বাজার বাসস্ট্যান্ডে বিভিন্ন দেশের পতাকা বিক্রি করছিলেন আবুল কাশেম নামের এক হকার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পতাকা বেচা (বিক্রি করা) আমার পেশা। সব সময় বাংলাদেশের পতাকা বেচি। এখন ফুটবলের মৌসুম, তাই ফুটবল দেশের পতাকা বেচছি। ভালো বেচাকেনা হচ্ছে। ছোট ছোট পতাকা বেশি বিক্রি হচ্ছে। বড় পতাকা খুব কমই বেচতে পারি। দাম বেশি, সবাই কিনতে চাই না।’
ওই হকার বলেন, ‘১০থেকে শুরু ৪০০ টাকা পর্যন্ত দামের পতাকা আছে আমার কাছে। আজ বড় পতাকা বেচছি দুইটা। একটা জার্মানির আর একটা ব্রাজিলের। অনেকেই দরদাম করে না। আবার অনেকেই করে। কেউ কেউ খুশি হয়ে আবার বেশিও দেয়। ভালো লাভও হয়। অর্ধেক টাকা লাভ হয়।’