‘বন্দুকযুদ্ধে’ কাউন্সিলরসহ নিহত ১০
সারা দেশে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা অব্যাহত আছে। গতকাল শনিবার রাতেও দেশের ১০ জেলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা আসার মূল ট্রানজিট পয়েন্ট কক্সবাজারের একজন নির্বাচিত কাউন্সিলরও আছেন। নিহত একরামুল হক টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন।
এ ছাড়া বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, মেহেরপুর, চাঁদপুর, কুষ্টিয়া, ঠাকুরগাঁও ও খুলনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সাত ‘মাদক ব্যবসায়ী’ নিহত হয়েছেন।
এ নিয়ে ৮ দিনে টানা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় সারা দেশে ৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন-
কক্সবাজার থেকে ইকরাম চৌধুরী টিপু জানিয়েছেন, মাদকবিরোধী অভিযানের সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে মেরিন ড্রাইভ সড়কের নোয়াখালীয়া পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে।
একরামুল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি টেকনাফ পৌর আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সভাপতি এবং তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন।
র্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন দাবি করেন, একরামুলের অবস্থান জানতে পেরে মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফের নোয়াখালী পাড়ায় র্যাব অভিযান শুরু করে। তখন একদল ইয়াবা ব্যবসায়ী র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি করে। র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যায়।
‘ঘটনাস্থল থেকে একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে স্থানীয়রা কাউন্সিলর একরামুলকে সনাক্ত করেন। সেখান থেকে ১০ হাজার ইয়াবা, একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ওয়ান শুটারগান উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদেহটি টেকনাফ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে’, যোগ করেন র্যাব কর্মকর্তা।
টেকনাফ থানার (ওসি) রনজিত কুমার বড়ুয়া জানান, ময়নাতদন্তের জন্য একরামুলের মৃতদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে টেকনাফসহ বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
ময়মনসিংহ থেকে আইয়ুব আলী জানিয়েছেন, ময়মনসিংহ শহরের মরাখলা এলাকায় গতকাল রাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক অজ্ঞাত যুবক নিহত হয়েছেন।
আজ রোববার ভোর রাতে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওসি মো. আশিকুর রহমান দাবি করেন, রাত দেড়টায় মরাখলা এলাকায় মাদক ভাগাভাগি করছিল ব্যবসায়ীরা। সংবাদ পেয়ে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশও গুলি করে। একজন গুলিবিদ্ধ হয়। তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ওসির আরও দাবি, এ সময় ডিবি পুলিশের দুই কনস্টেবল হুমায়ুন ও আমির হামজা গুরুতর আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে ১০০ গ্রাম হেরোইন, চারটি গুলির খোসা, দুটি রামদা এবং ১০০ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
বাগেরহাট থেকে রবিউল ইসলাম জানিয়েছেন, বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে মিথুল বিশ্বাস (৩২) নামে এক মাদক বিক্রেতা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।
আজ ভোরে উপজেলার কলাতলা ইউনিয়নের পিংগুড়িয়া এলাকায় এ ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে।
নিহত মিথুল ওই এলাকার বাসিন্দা। তাঁর বিরুদ্ধে বাগেরহাটের বিভিন্ন থানায় হত্যা, মাদক ও পুলিশের ওপর হামলাসহ ২০টি মামলা রয়েছে।
চিতলমারী থানার ওসি অনুকূল বিশ্বাস দাবি করেন, মিথুল দীর্ঘদিন ধরে মাদক বিক্রি করে আসছিলেন। গত রাতে পুলিশ তাঁর মাদক বিক্রির আস্তানায় হানা দেয়। এ সময় তাঁর দলবল পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশও পাল্টা গুলি করে।
‘গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মিথুল পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে আটক হন। তাঁকে চিতলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। লাশ বাগেরহাট সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।’
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুই কেজি গাঁজা, ১০টি ইয়াবা, একটি শার্টারগান ও দুটি গুলি উদ্ধার করে বলে দাবি করেছেন ওসি।
নোয়াখালী থেকে মো. মাসুদ পারভেজ জানিয়েছেন, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির বগাদিয়া গ্রামে গতকাল মধ্যরাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হাসান ওরফে ‘ইয়াবা হাসান’ নিহত হয়েছেন। তাঁকে গতকাল দুপুরে সোনামুড়ি বাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
হাসান সোনাইমুড়ি থানার ভানুয়াই গ্রামের বাসিন্দা। তিনদিন পরই তাঁর ব্রাজিল চলে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি তিন সন্তানের জনক। তাঁর বিরুদ্ধে সোনাইমুড়ি থানায় মাদক ও অস্ত্রসহ মোট ২১টি মামলা রয়েছে।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম দাবি করেছেন, হাসানকে আটকের পর তাঁকে নিয়ে বগাদিয়া গ্রামে ইয়াবা উদ্ধারে যায় পুলিশ। তখন ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান হাসান।
পুলিশ কর্মকর্তার দাবি, ঘটনাস্থল থেকে একটি এলজি, সাতটি গুলি ভর্তি কার্তুজ, ১২০টি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ সময় তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের বজরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
চাঁদপুর থেকে হাবিবুর রহমান খান জানিয়েছেন, চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সেলিম নামের এক ‘মাদক ব্যবসায়ী’ নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।
মতলব দক্ষিণ থানার ওসি মো. কুতুব উদ্দিন দাবি করেন, ভোর রাত পৌনে ৩টায় মতলব সড়কের হাজীর ডোন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাতটি মাদক মামলার আসামি সেলিমকে আটক করা হয়। এ সময় সেলিমের সহযোগীরা পুলিশের ওপর গুলি ও হামলা চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এতে সেলিম গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে মতলব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ওসির আরও দাবি, এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ ছাড়া চারটি গুলি, ছয়টি কার্তুজ, ১১০টি ইয়াবা ও দুটি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
মেহেরপুর থেকে রেজ আন উল বাসার তাপস জানিয়েছেন, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় দুই দল মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে গোলাগুলির সময় হাফিজুর রহমান হাফি (৪৮) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।
হাফিজুর রহমান হাফি গাংনী সরকারি ডিগ্রি কলেজপাড়ার বাসিন্দা। তাঁর নামে গাংনী থানায় মাদকের দুই ডজনের বেশি মামলা রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
গাংনী থানার ওসি হরেন্দ্রনাথ সরকার দাবি করেন, রাত আড়াইটার দিকে গাড়াবাড়য়ী গ্রামের বাথানপাড়া মাঠে দুই দল মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে গোলাগুলির খবর পায় পুলিশ। পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে গুলিবিদ্ধ এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠায়। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁকে সনাক্ত করেন।
ওসির আরও দাবি, ঘটনাস্থল থেকে বস্তাভর্তি ১১২ বোতল ফেনসিডিল ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।
কুষ্টিয়া থেকে সাবিনা ইয়াসমিন শ্যামলী জানিয়েছেন, কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হালিম মণ্ডল (৩৫) নামের এক ‘মাদক ব্যবসায়ী’ নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।
গতকাল শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে শহরের হাউজিং ডি ব্লক মাঠে এ ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে। হালিম মণ্ডল সদর উপজলার বড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা।
কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি নাসির উদ্দিন দাবি করেন, মাদক ব্যবসায়ীরা শহরের হাউজিং ডি ব্লক মাঠে মাদক বেচাকেনা করছে এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশ সেখানে অভিযানে যায়। তখন সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এ সময় একজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে হালিমের পরিচয় সনাক্ত করা হয়।
ওসির আরও দাবি, এ ঘটনায় এসআই মোস্তাফিজুর রহমান, এএসআই হাসান আলী, কনস্টেবল শফিক হোসেন ও হাসান আলী আহত হলে তাদের কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি শার্টারগান, একটি পাইপগান, তিনটি গুলি ও ৮০০ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। হালিম পুলিশের তালিকভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী।
ঝিনাইদহ থেকে মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ‘দুই দল মাদক ব্যবসায়ীর’ মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ। গতকাল রাত সোয়া ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
শৈলকুপা থানার ওসি মো. আলমগীর হোসেন দাবি করেন, ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া মহাসড়কের বড়দা জামালপুর নামক স্থানে এ ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে একটি লাশ উদ্ধার করে। এ ছাড়া একটি ওয়ান শুটারগান, ১০ বোতল ফেনসিডিল, ৪০০-৫০০ ইয়াবা এবং পিস্তলের দুটি ও বন্দুকের দুটি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও থেকে লুৎফর রহমান মিঠু জানিয়েছেন, ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় মীরডাঙ্গী দৌলতপুর এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে রফিকুল ইসলাম তালেবান (৫৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।
জেলা পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ দাবি করেন, গতকাল রাতে পুলিশ ভরনিয়া মীরডাঙ্গী এলাকায় অভিযানে গেলে মাদক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম তালেবানের লোকজন পুলিশের ওপর গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় রফিকুল ইসলাম তালেবান নিহত হন। তাঁর লাশ ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে রাখা আছে।
পুলিশ সুপারের আরও দাবি, এ সময় দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র ও ১০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে পুলিশ। রফিকুল পুলিশের তালিকাভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী। তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি মামলা রয়েছে।
খুলনা থেকে মুহাম্মদ আবু তৈয়ব জানিয়েছেন, খুলনার দিঘলীয়া উপজেলার সিদ্দিপাশার বারকপুরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহত কালাম মোল্লা (৪০) যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার ইশামতি এলাকার বাসিন্দা।
দিঘলীয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান দাবি করেন, গতকাল রাত ১টার পর পুলিশ সিদ্দিপাশার বারকপুরে মাদকবিরোধী অভিযানে যায়। তখন সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। পরে ঘটনাস্থলে কালাম মোল্লার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
ওসির আরও দাবি, ঘটনাস্থল থেকে চারটি ককটেল, ১০০ ইয়াবা, একটি এয়ারগান, চারটি কার্তুজ ও একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। কালামের নামে অভয়নগর থানায় চারটি মাদক মামলা রয়েছে।
এদিকে খুলনা জেলার ৩৩৪ জন মাদক ব্যবসায়ী ও সহযোগিতাকারীদের মধ্যে দিঘলীয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমানের নাম ১০ নম্বরে রয়েছে। এর আগে জেলা পুলিশ সুপার নিমাজ উদ্দীন মোল্লা বিষয়টি স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, এ নিয়ে তদন্ত চলছে।