অধ্যাপক রেজাউল হত্যা : দুজনের ফাঁসি, তিনজনের যাবজ্জীবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলার রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সক্রিয় দুই সদস্যের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। হত্যাকাণ্ডের সহযোগী হিসেবে জেএমবির তিন সদস্যকে অভিযুক্ত করে আদালত তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশসহ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন।
আজ মঙ্গলবার রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক শিরীন কবিতা আকতার দেশব্যাপী আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় দেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, দণ্ডপ্রাপ্তরা দেশে ইসলামী খেলাফত ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। আর এই ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় যারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদের এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
চাঞ্চল্যকর এই মামলায় আদালতে দায়ের করা অভিযোগপত্রে আট আসামিকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন খায়রুল ইসলাম বাঁধন, নজরুল ইসলাম ও তারেক হাসান ওরফে বাইক হাসান। তিন আসামি মৃত্যুবরণ করায় রায়ে বিচারক ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী মামলা থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেন।
রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জেএমবি সদস্যরা হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম ওরফে খালিদ ওরফে রাহাত এবং বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সাদুরিয়া ছাতিয়ানপাড়া গ্রামের মাসকাওয়াত হাসান শাকিব ওরফে মাসুদ ওরফে আবদুল্লাহ। তাঁদের মধ্যে শরিফুল ইসলাম ঘটনার পর থেকেই পলাতক।
আর যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপসায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের মিয়াপাড়া গ্রামের রহমত উল্লাহ ওরফে শাহিন, রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানাধীন নারিকেলবাড়িয়া পূর্বপাড়া গ্রামের আবদুস সাত্তার ও তাঁর ছেলে রিপন আলী। যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।
বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন, দণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিরা পরস্পর আত্মীয় না হলেও তারা একই আদর্শের অনুসারী জেএমবির সক্রিয় সদস্য। আবদুস সাত্তার জেএমবির কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নিয়মিত চাঁদা দিতেন। তাঁর বাড়িতে বসেই রাবির অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। জেএমবি সদস্য রহমত উল্লাহ, সাত্তার ও রিপন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকলেও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে তাঁরা জড়িত থেকে সহযোগিতা করেছেন।
বিচারক বলেন, মামলার প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষী না থাকলেও গ্রেপ্তারের পর আসামিদের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য ও প্রয়োজনীয় আলামত পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে দণ্ডপ্রাপ্তরা দেশে ইসলামী খেলাফত ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে।
মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক বিরোধ না থাকা সত্ত্বেও যে আদর্শিক জায়গা থেকে আসামিরা প্রগতিশীল এক শিক্ষককে হত্যা করেছেন, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এন্তাজুল হক বাবু। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য একজন প্রগতিশীল শিক্ষককে হত্যা করা হবে, এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। উগ্রপন্থীদের নির্মূল করতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর ছেলে মামলার বাদী রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ রায়ের পর তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সব আসামির সর্বোচ্চ রায় হলে আরো ভালো লাগত। তিনি বলেন, মামলার মূল পরিকল্পনাকারী এবং ঘটনার পর থেকে পলাতক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র শরিফুল ইসলাম খালিদকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে রায় কার্যকরের আওতায় আনা হোক।
অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভি দাবি করেন, উচ্চ আদালতেও যেন এই রায় বলবৎ থাকে এবং মামলার রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়।
একই ধরনের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অধ্যাপক রেজাউল করিমের সহকর্মী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মাসুদ আকতার।
তবে বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার না পাওয়ার দাবি করে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মাসকাওয়াত হাসানের আইনজীবী মলয় কুমার ঘোষ এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত সাত্তার ও রিপনের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম উচ্চ আদালতে আপিলের কথা বলেছেন। তাদের প্রত্যাশা, উচ্চ আদালতে মামলার আসামিরা নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।
২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে রাজশাহী নগরীর শালবাগান এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে ৫০ গজ দূরে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। ঘটনার পরদিন তাঁর ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে বোয়ালিয়া মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রেজাউস সাদিক গত বছরের ৬ নভেম্বর আদালতে আটজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষে মঙ্গলবার দুপুরে রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলার রায় ঘোষণা করেন।