আট মাসেও রায় প্রকাশ হয়নি, অসন্তোষ উভয়পক্ষে
২০১৪ সালের আজকের দিনে (২৭ এপ্রিল) নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করে র্যাব-১১ এর সদস্যরা। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের এবং ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ওই সাত খুন মামলায় বিচারিক আদালত ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলেও হাইকোর্ট গত বছর আপিলের রায়ে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। গত বছরের ২২ আগস্ট এ রায় ঘোষণা করা হলেও দীর্ঘ আট মাসেও রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়নি। এ কারণে রায় বাস্তবায়ন বা এর বিরুদ্ধে এখনো আপিল করার সুযোগ পাচ্ছে না রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিরা। এতে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানান উভয়পক্ষের আইনজীবীরা।
এ ঘটনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল পৃথক দুটি মামলা করেছিলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘দেশের আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। গত বছরের আগস্টে হাইকোর্টের রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ১৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। যেখানে নিম্ন আদালত দিয়েছিল ২৬ জনকে। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল দায়ের করব।’ যাদের ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে চূড়ান্ত হবে।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ লেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা প্রাথমিকভাবে রায়টি লেখা শেষ করেছেন। তবে রায়ের কপি দেখা শেষে রায় প্রকাশ করা হবে।’
এদিকে এ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আরিফ হোসেনের আইনজীবী এস এম শাহজাহান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আমরা আসামির পক্ষে আপিল দায়ের করব। আমি মনে করি ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়াটাই ভালো। কেননা এসব আসামি দীর্ঘদিন ধরে কনডেম সেলে (কারাগারে ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত স্থান) অবস্থান করছে। এতে করে মানসিকভাবে তাঁরা বিকলাঙ্গ হয়ে যান।’
গত বছরের ২২ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আপিলের রায় ঘোষণা করেন। আপিলের রায়ে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এদের মধ্যে প্রধান আসামি নূর হোসেন, র্যাবের বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, এম এম রানা, আরিফ হোসেন রয়েছেন। ঘোষিত রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত।
ফাঁসি বহাল যাদের
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, চাকরিচ্যুত কমান্ডার এম এম রানা, চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ হোসেন, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, এবি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, সৈনিক বেলাল হোসেন, সৈনিক আল আমীন, আবু তৈয়ব আলী, মো. শিহাবউদ্দিন, পূর্ণেন্দু বালা, আবদুল আলিম, মনিরুদ্দিন মুন্সী ও তাজুল ইসলামের ফাঁসি বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট।
মৃত্যুদণ্ড কমে যাবজ্জীবন হলো যাদের
আসাদুজ্জামান নূর, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তজা জামান চার্চিল, সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাজাহান ও জামাল সরদারের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
নিম্ন আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত নয়জনের সাজা বহাল থাকা আসামিরা হলেন, করপোরাল রুহুল আমিন (১০ বছর), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবুল কালাম আজাদ (১০ বছর), এএসআই বজলুর রহমান (৭ বছর), হাবিলদার নাসির উদ্দিন (৭ বছর), সৈনিক নুরুজ্জামান (১০ বছর), কনস্টেবল বাবুল হাসান (১০ বছর), করপোরাল মো. মোখলেছুর রহমান (পলাতক)অপহরণের দায়ে ১০ বছর, এএসআই (পলাতক) কামাল হোসেন অপহরণের দায়ে ১০ বছর, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান অপহরণের দায়ে ১০ বছর এবং আলামত সরানোর দায়ে ৭ বছরসহ মোট ১৭ বছর দণ্ড।
পলাতক আসামি সাত
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল জনান, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সি, আল আমিন শরিফ, মো. তাজুল ইসলাম এখনও পলাতক। এছাড়া যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে মো. সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান এবং ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত করপোরাল মো. মোখলেছুর রহমান, এএসআই মো. কামাল হোসাইন পলাতক।
রায়ের দিন সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন আইনজীবী নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা আক্তার বিউটি। তিনি বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। এ রায় যেন আপিল বিভাগে বহাল থাকে এবং দ্রুত কার্যকর করা হয়।’
এর ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সাত খুনের দুই মামলায় মোট ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন। পরে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল দায়ের করেন। একইসঙ্গে রায় কার্যকরে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মামলাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি করার জন্য বেঞ্চ গঠন করে দেন। দীর্ঘদিন শুনানি শেষে একই বছরের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করে। কিন্তু ওই রায় এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
মামলার নথি থেকে জানা যায়,চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৩ জন কারাবন্দি। এদের মধ্যে ২১ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি দেন। এ মামলায় ১০৬ সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
তবে তদন্ত শেষ হওয়ার পর প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনায় তাঁর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে তার গাড়িচালক মিজানুর রহমান দীপু জবানবন্দি দিতে রাজি হননি।
ক্যাপশন
নির্মম হত্যার শিকার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তাঁর সহযোগী সিরাজুল ইসলাম লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিম। ছবি : সংগৃহীত