হান্নানের জেল খাটেন সেলিম, শোভার বদলে হাজেরা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ছোটকুড়ি পাইকা গ্রামের দরিদ্র সেলিম মিয়ার সংসার চলে রিকশা চালিয়ে। রিকশাটি তিনি প্রতিদিনের জন্য ভাড়া নেন। স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে সাত-আটজেনর পরিবার। ফলে অভাব তাঁর নিত্যসঙ্গী। তার মধ্যে অসুখ-বিসুখ হলে রিকশা চালাতে পারেন না। তখন অনেক সময় উপোস দিয়ে দিন পার করতে হয়।
এই টানাপড়েনের মধ্যেই একদিন সেলিমের পরিচয় হয় হান্নান মোল্লার সঙ্গে। পরিচয়ের সূত্র ধরেই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। হান্নান মাদকের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। মাঝে মাঝেই সেলিমের বাড়িতে আসেন।
একদিন হান্নান মোল্লা বাড়িতে এসে সেলিমকে বলেন, তাঁর নামে একটি মামলা হয়ে গেছে। আদালতে হাজিরা দিতে হবে। তাঁর পরিবর্তে সেলিম যদি সেই মামলায় হাজিরা দেন তাহলে তিনি তাঁকে একটি রিকশা কিনে দেবেন। তাঁকে আর কষ্ট করে রিকশা চালাতে হবে না। কিছু নগদ টাকাও দেওয়া হবে। বড়জোর সাত-আট দিন জেলে থাকতে হতে পারে। তারপর জামিনে বের হয়ে যাবেন। অভাবের তাড়নায় রাজি হয়ে যান রিকশাচালক সেলিম।
সেলিমের স্ত্রী হোসনা বেগম জানান, গত ১১ মার্চ হান্নান মোল্লা বাড়িতে এসে তাঁর হাতে ৫০০ টাকা গুজে দেন। আর সেলিমকে একটি মোটরসাইকেলে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে নিয়ে যান। ওইদিন বিকেলে জেলা মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মাদকের মামলায় হান্নান মোল্লার বদলে সেলিম হাজিরা দেন। সেলিম নিজেকে হান্নান মোল্লা বলে দাবি করেন। জামিন নামঞ্জুর করে আদালত সেলিমকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
হোসনা বেগম বলেন, ‘প্রথমে আমি জানতে পারি নাই। পাঁচ-সাতদিন পর কারাগার থেকে ফোন আসে আমার স্বামী জেলে। এরপর আবার জামিন বাতিল হয়। আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে উপাস থাকছি। আমার স্বামীকে এনে দিন।’
সেলিমের বৃদ্ধ বাবা আবুল ফয়েজ বলেন, ‘আমার ছেলেকে পটিয়ে নিয়ে জেলে দিয়েছে হান্নান। ছেলেকে ফিরিয়ে দিন।’
গত ২৩ মার্চ জেল সুপার কারাগার পরিদর্শনকালে সেলিমের ঘটনাটি জানতে পারেন। পরের দিন তিনি তা সংশ্লিষ্ট আদালতকে জানান। এর সূত্র ধরে সামনে আসে মাদক মামলার আরেক কাহিনী। তবে সেই মামলায় পুরুষ নয়, এক নারী আসামির বদলে জেল খাটছেন আরেক নারী।
আখাউড়া উপজেলার নূরপুর গ্রামের বাসিন্দা কাউসার মিয়া আর স্ত্রী হাজেরা বেগম। এই দম্পতির এক ছেলে আর এক মেয়ে রয়েছে। কাউসার মিয়া অসুস্থ থাকায় হাজেরাকেই বেশির ভাগ সময় সংসার নির্বাহ করতে হয়। স্বামীর চিকিৎসা ব্যয় আর সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় হাজেরাকে।
হাজেরা বেগমের পরিবার জানায়, স্বামীর চিকিৎসা আর সংসারের টাকা জোগাড় করতে শোভা বেগমের (৪০) বিরুদ্ধে দায়ের করা মাদকের মামলায় বদলি হাজিরা দিতে রাজি হন তিনি। এই মামলার আইনজীবী ছিলেন মোছা. দোলনু আরা। তিনিই সব ব্যবস্থা করে দেন।
হাজেরা বেগমের মেয়ে হালিমা আক্তার বলেন, ‘গত ৬ মার্চ শোভা বেগমের মাদক মামলায় আমার মা আদালতে উপস্থিত হন। আদালতে তিনি নিজেকে শোভা বেগম (৪০) বলে দাবি করেন। আদালত সেদিন জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান।’
‘আমার মা-ই সবকিছু। উকিল মাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। প্রথমে আমরা বুঝতে পারি নাই। ভাবছি, বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে মা হয়তো কোথাও গেছে। পরে শুনি উকিল এসব করছে। এখন মানুষের বাড়ি থেকে চেয়ে চেয়ে ভাত খাচ্ছি’, যোগ করেন হাজেরার মেয়ে।
বদলি হাজিরা আর জেল খাটার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর আদালত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের আদেশের পর আসামি হান্নান মোল্লা ও কারাগারে দুই বন্দির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। সেইসঙ্গে একটি মামলার আইনজীবী মোছা. দোলনু আরাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সোহাগ রানা জেলা কারাগারে গিয়ে বন্দিদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এস এম ইউসুফ বলেন, মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই আইন বহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ড ন্যক্কারজনক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান বলেন, মাদক মামলার আসামি হান্নান মোল্লা ঘটনার পর পর ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বক্তব্যের জন্য মাদক মামলার আইনজীবী মোছা. দোলনু আরা বেগমের মোবাইল ফোনে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। তাঁর বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি।