একটি নাম-কিছু উদ্যোগ, বদলে গেল ভূমি অফিস
পুরোনো একটি উইয়ের ঢিবি। তার ডানে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা ফিকে একতলা ভবন। কার্যালয়ের উঠান, বারান্দায়, এমনকি ভেতরে টুল বা চেয়ারে বসা বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। কে দালাল আর কে এই কার্যালয়ের চাকুরে তা এক সময় বোঝা দায় ছিল।
অফিস কর্তার ভারী পর্দাওয়ালা দরজায় বসা থাকতেন এক সহকারী। যাকে দেখলেই পিলে চমকে যেত সেবাগ্রহীতাদের। দালালদের পেছনে ঘুরে ঘুরে জমির নামজারি বা বন্দোবস্তের কাজ করতে হতো। এ রকমই ছিল ফরিদপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিসের চিত্র।
কিন্তু সেই চিত্র আর নেই। ভূমি কার্যালয় নিয়ে মানুষের নেতিবাচক ধারণা পাল্টে দিয়েছেন একজন সহকারী কমিশনার (এসি-ল্যান্ড)। তিনি হলেন পারভেজ মল্লিক। সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের চিরচেনা জটিলতা দূর করে দিয়েছে, এই একটি নাম।
ফরিদপুর সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়কে জেলার মধ্যে সবচেয়ে ডিজিটাল ও আধুনিক করে গড়ে তুলেছেন পারভেজ মল্লিক, যা হতে পারে সারা দেশে অনুকরণীয়।
৩৩তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা পারভেজ মল্লিক গত ৬ নভেম্বর ফরিদপুর সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি নানামুখী উদ্যোগ নেন। শুরুতেই পুরো অফিস ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় এনে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দালাল মুক্ত করেন।
ভূমি কার্যালয়ে চুনকাম করা সীমানা প্রাচীর ও সুদৃশ্য গেট তৈরি করা হয়েছে। ভবনের বাইরে টবে দেওয়া হয়েছে নানা প্রজাতির ফুল ও সৌন্দর্যবর্ধক গাছ। জরাজীর্ণ দেয়ালগুলোও রাঙানো হয়েছে নতুন রঙে। এসি ল্যান্ডের কক্ষ ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কক্ষেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
কার্যালয়ের মুখেই টাঙানো নাগরিক সনদ। তাতে ভূমি সেবা-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য দেওয়া আছে। কার্যালয়ে ঢুকতে গেলে সেই উইয়ের ঢিবি আর দেখা যায় না, সেখানে রয়েছে বিশ্রামের জায়গা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজন সেখানে বিশ্রাম নেয়।
ভূমি কার্যালয়ে ঢোকার মুখে বাঁ পাশে একটি সহায়তা ডেস্ক। সেখানে একজন কর্মচারী সেবাপ্রার্থীদের তথ্য সহায়তা দেন। তার পাশের একটি বাক্সে সাজানো আছে নানা আবেদন ফরম। সেখান থেকে সেবাপ্রার্থীরা বিনা খরচে ফরম নিতে পারেন। কর্মচারীদের গলায় ঝুলছে পরিচয়পত্র। প্রতিটি কক্ষে ছোট্ট একটি সাদা বোর্ডে কর্মচারীদের প্রতিদিনের কাজ লেখা। দিন শেষে এসি ল্যান্ড সেগুলো ধরে ধরে মূল্যায়ন করেন।
সার্বিক ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল সেবা প্রদান কার্যক্রম চালু হয়েছে এ কার্যালয়ে। একটি অ্যাপ্লিকেশন বেইজড ওয়েবসাইট ও অনলাইন মেসেজিং কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে এরই মধ্যে উপজেলা ভূমি কার্যালয় তার ডিজিটাল পথ চলা শুরু করেছে। এই উদ্যোগটি সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে। ই-নামজারির কাজ চলছে পুরো উদ্যমে। এখন বিশ্বের যেকোনো স্থানে বসে অনলাইনে নামজারির জন্য আবেদন করতে পারবেন সেবাপ্রার্থীরা। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইলে ফিরতি খুদে বার্তার মাধ্যমে তাকে নিশ্চিত করা হচ্ছে। ই-হাজিরা স্থাপনের মাধ্যমে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর অফিস হাজিরা নিশ্চিত হয়েছে।
সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে কথা হয় নজরুল ইসলাম নামের এক সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘আগে দালালের জন্য এ অফিসে ঢোকাই যেত না। আর এখন অফিসে কোনো দালাল নেই। আমরা সরাসরি এসে সরকারি ফি জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করে সঠিক সময়ে সেবা পাচ্ছি।’
অন্য এক সেবাপ্রার্থী শেখ হামিদ বললেন, ‘ভূমি অফিসের কাজ মানেই দালালের দৌরাত্ম্য। দিনের পর দিন হয়রানি। কর্মচারীদের অবজ্ঞার পাশাপাশি বাড়তি খরচ। কিন্তু এখানে এসে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। আর এই বদলের পেছনের মানুষটি হলেন এসি ল্যান্ড পারভেজ মল্লিক।’
সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের গোলঘরে প্রতি বুধবার গণশুনানির মাধ্যমে জনগণের নানা ধরনের সমস্যার কথাশুনে তার সমাধানের ব্যবস্থা করছেন এসি ল্যান্ড। কক্ষের দরজাগুলোয় যে পর্দা ছিল সেগুলো তুলে দিয়েছেন। এখন আর রুমগুলোতে কোনো পর্দা নেই। নেই কোনো অফিস সহকারী। এসি ল্যান্ডের কাছে কোনো সেবাপ্রার্থীর যেতে লাগে না কোনো অনুমতি। এমনকি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে বিভ্রান্ত অপেক্ষমাণ কাউকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে নিজ কক্ষ থেকে বাইরে এসে তাঁর সমস্যার কথা শুনে তাঁর সেবা নিশ্চিত করছেন।
এ ব্যাপারে পারভেজ মল্লিক জানান, ‘একটা সময় ছিল, কর্মকর্তারা কক্ষে বসে বেল চাপতেন। বাইরে অপেক্ষমাণ সেবাপ্রার্থীরা ভারী পর্দা সরিয়ে এক এক করে কক্ষে ঢুকতেন। তাঁর আগে অফিস সহায়কের কাছে অনুমতি নিতে হতো। আমি প্রথমে এসেই এই পর্দা সরিয়েছি। সেবাপ্রার্থী ও সেবাদানকারীর মধ্যে ফারাক সৃষ্টির কোনো সুযোগ রাখিনি।’
এসি ল্যান্ড বলেন, ‘ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের নির্দেশে আধুনিক ও সেবামুখী ভূমি অফিস বিনির্মাণের প্রত্যয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দ্রুত সময়ে সেবা প্রদানই আমার লক্ষ্য।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, ভূমি অফিস ডিজিটালাইজেশন ডিজিটাল বাংলাদেশের আরেকটি সফল উদ্যোগ। তিনি সব উপজেলায় এ মডেল চালুর উদ্যোগ নেবেন বলে জানান।