লিবিয়ায় অপহরণ, বাংলাদেশে সম্পদের পাহাড়, চক্র শনাক্ত
ফোন আসত লিবিয়া থেকে। বলা হতো, লিবিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা অপহরণের শিকার হয়েছেন। মুক্তিপণ দাবি করা হতো। অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের বাংলাদেশে থাকা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে মুক্তিপণ দিতে হতো। মুক্তিপণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলে নির্যাতন।
একাধিক দফা মুক্তিপণ দিলেও খোঁজ পাওয়া যেত না। সম্প্রতি এ ধরনের অপহরণের সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের একটি চক্রের মূল হোতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর নাম মিরাজ হাওলাদার। তিনি মাদারীপুরের বাসিন্দা। বর্তমানে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। মিরাজের স্ত্রী ময়না ও বাবাসহ একাধিক ব্যক্তিকে আটক করেছে র্যাব। মিরাজ কালকিনি উপজেলার শিকারমঙ্গল এলাকার বাসিন্দা।
অপহরণের শিকার ব্যক্তিরা লিবিয়াতে কাজ করেন। অনেককে আবার ইতালি নিয়ে যাওয়ার নাম করে লিবিয়াতে নিয়ে অপহরণ করা হয়।
দেশের কয়েক হাজার যুবককে জিম্মির পর মুঠোফোনে অত্যাচারের অডিও, ভিডিও স্বজনদের দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ওই চক্র।
র্যাব জানিয়েছে, মিরাজের নেতৃত্বেই এ দেশের আরো বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতকারী লিবিয়ার নাগরিকদের নিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০টি দল তৈরি করে লিবিয়াজুড়ে অপহরণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। সম্প্রতি লিবিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় র্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্পের টানা অভিযানে এসব চক্রের সন্ধান মিলেছে। লিবিয়ায় জিম্মি ও মুক্তিপ্রাপ্তদের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে মিরাজ ও তাঁর মাফিয়া বাহিনীর অত্যাচারের লোমহর্ষক তথ্য।
গন্তব্য ইতালি, পথ লিবিয়ায়
লিবিয়ায় গাদ্দাফি বিরোধী যুদ্ধের পর ওই দেশের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে ইতালিতে অভিবাসীদের ঢল নামে। সেই থেকে মাদারীপুরসহ সারা দেশের যুবকদের ইতালি যাওয়ার মূল গন্তব্য হয়ে ওঠে লিবিয়া রুট। ভাগ্যের উন্নয়নে এ যেন ঢল নামে লিবিয়ামুখে। যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করায় পাঁচ-ছয় বছর ধরেই লিবিয়ায় গিয়েই মাফিয়া গ্যাং বা অপহরণকারীদের নামে হাজার হাজার বাংলাদেশিকে অপহরণ করে জিম্মির পর মুঠোফোনে ইমোতে অত্যাচারের অডিও ভিডিও স্বজনদের দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছিল।
মাদারীপুরের শতাধিক যুবক অপহৃত
গত ছয় মাসে মাদারীপুরের চার উপজেলার শতাধিক যুবককে অপহরণের ঘটনা ঘটে এবং একই কায়দায় মুক্তিপণ আদায় চলছিল। অপহৃতদের পরিবারগুলো সন্তানদের বাঁচাতে বাধ্য হয়ে জমিজমা বাড়িঘর বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে এ দেশীয় দালালদের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করেও দফায় দফায় জিম্মির শিকার হতো। ভুক্তভোগীদের কয়েকজন র্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্পে অভিযোগ দিলে গত তিন মাসে এ দেশীয় সহযোগী আটজনকে আটক করে। মুক্তিও পায় অন্তত ১৬ জিম্মি।
মাদারীপুর র্যাব ক্যাম্প স্বপ্রণোদিত হয়ে লিবিয়ায় বাংলাদেশি হাইকমিশনের সহায়তা নিয়ে যৌথ তদন্তে নিশ্চিত হয় লিবিয়াজুড়ে চলা এই অপহরণ চক্রের মূল হোতা জেলার কালকিনি উপজেলার শিকারমঙ্গল ইউনিয়নের মৃধাকান্দি গ্রামের হোসেন হাওলাদারের ছেলে মিরাজ হাওলাদার। ছয় বছর আগে মিরাজ লিবিয়ায় যাওয়ার পর যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে রাজৈরের মনির, সুমন, ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার দুই ভাই সোহাগ ও আলমগীর, ময়মনসিংহের রাজেলসহ ২০ থেকে ২৫ জনকে নিয়ে গড়ে তুলে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র অপহরণ গ্রুপ। ওই দলে লিবিয়ার নাগরিকরাও আছে।
অপহরণের টাকা আদায়ে মিরাজসহ চক্রের সদস্যরা তাদের মা, বাবা, স্ত্রীসহ স্বজনদের ব্যাংক হিসাব ও বিকাশ নম্বরে মুক্তিপণের টাকা জমা নিত। তদন্তে নিশ্চিত হয়ে র্যাব এরই মধ্যে আটক করেছে মিরাজের স্ত্রী ময়না ও বাবাকে।
সরেজমিনে মিরাজের কালকিনির শিকারমঙ্গলের মৃধাকান্দি গিয়ে দেখা যায়, মিরাজের দুই তলার অত্যাধুনিক বাড়িতে এক ফ্লোরেই ১২টি কক্ষ। আসবাবপত্র বেশ দামি। তাঁর হঠাৎ উত্থানে বিস্মিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার মানুষ।
‘জিম্মি করে টাকার জন্য পেটাত’
লিবিয়ায় জিম্মি এক যুবকের স্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমার স্বামী এক বছর আগে লিবিয়ায় যান। এরপর ইতালি নেওয়ার কথা বলে মিরাজ ও তার গ্যাংয়ের লোকজন ৯ মাস ধরে আমার স্বামীকে জিম্মি করে রেখেছে। ওরা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে মোবাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে আমাকে দেখিয়ে মুক্তিপণ বাবদ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে আমার স্বামীকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ পর্যন্ত চার লাখ টাকা দিয়েছি। তবু ওরা আমার স্বামীকে ছাড়েনি। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।’
আরেক জিম্মি যুবকের ভাই বলেন, ‘আমার ভাইসহ এলাকার ১৮ জন যুবককে জিম্মি করে রেখেছে মিরাজ। ছয়জনের মুক্তিপণ বাবদ মিরাজের স্ত্রী, বাবা ও ভাবির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আমি নিজে এ পর্যন্ত ৯ লাখ টাকা দিয়েছি। তবু কাউকে ছাড়েনি। মিরাজের সঙ্গে এই চক্রে লিবিয়ার নাগরিক ছাড়াও রাজৈরের মনির, সুমন, ফরিদপুরের নগরকান্দার সোহাগ, আলমগীর, ময়মনসিংহের রাজেলসহ ২০ থেকে ২৫ জন রয়েছে বলে আমার ভাই আমাকে জানিয়েছেন।’
মিরাজ মাফিয়া গ্যাংকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি পাওয়া শরীয়তপুরের বোরহান জমাদ্দার বলেন, ‘আমার বাবা জমি বিক্রি করে আমাকে লিবিয়া পাঠিয়েছিলেন। আমি সেখানে ৩০ হাজার টাকা বেতন পেতাম। এই মিরাজ ইতালি নেওয়ার কথা বলে আমাকে জিম্মি করে সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরে ছ্যাকা দিত। বন্দুকের বাট, লোহার পাইপ, কোমরের বেল্ট দিয়ে পিটাত। পানি চাইলে খালি বোতল দিত। নিজের প্রস্রাবই খেতে হতো। মোবাইলে ভিডিও কল দিয়ে আমার মা-বাবাকে তা দেখাত। একবার টাকা দিয়ে ছাড়ার পর ওর আরেক গ্রুপ মনিরের নামে আবার ধরে অত্যাচার করে দুই বার টাকা নেয়। দুই বারে ঋণ করে টাকা এনে সাড়ে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে মিরাজ গ্যাং আমাকে ছেড়েছে। ওর গ্যাংগুলো হাজার হাজার যুবককে এভাবে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমি ওর বিচার চাই।’
অপহরণের শিকার মাগুরার বিদ্যুৎ নামের এক যুবক মুঠোফোনে বলেন, ‘লিবিয়ায় মিরাজের সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ জন অস্ত্রধারী লিবিয়ানও রয়েছে। আর বাংলাদেশি ২৫ থেকে ৩০ জন রয়েছে তার সঙ্গী। বাংলাদেশে মিরাজের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সবাই এই চক্রের সদস্য। ওরা আমাদের হাজার হাজার যুবককে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে বাংলাদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। ওরা আমাদের ওপর প্রতিনিয়ত অমানুষিক নির্যাতন করে।’
বিদ্যুতের সঙ্গে একই কক্ষে থাকা আরো অন্তত ২০ জন বাংলাদেশি মুঠোফোনের মাধ্যমে এই প্রতিবেদককে সিগারেটের ছ্যাকা-গভীর ক্ষত, অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখান। সবাই মিরাজের ওই চক্রের নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
‘চক্র শনাক্ত হওয়ায় রুটটি বন্ধ হবে’
কালকিনির শিকারমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সিরাজুল আলম মৃধা বলেন, ‘ফোনে মিরাজের কাছে আমি এই অপহরণে বিষয় জানতে চাইলে তিনি জানান, তাঁর কাছে ১০ থেকে ১২ জন লোক আছে। কিন্তু আমার জানা মতে লিবিয়ায় একজন বাংলাদেশি সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন পায়। এই বেতনে মিরাজ তার বাড়িতে এত সম্পদের পাহাড় কীভাবে করেছে তা আমার বোধগম্য নয়। মিরাজের এই অপকর্মের কারণে আমার ইউনিয়নের বদনাম হচ্ছে। আমি সরকারের কাছে এটার কঠোর বিচার দাবি করছি।’
লিবিয়ায় বাংলাদেশি হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর মো. আশরাফুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘যেহেতু লিবিয়ায় বর্তমানে কোনো বৈধ পুলিশ বাহিনী নেই, মিলিশিয়ারা কোনো রকমে কাজ চালাচ্ছে। সেই সুযোগে বেশ কয়েকটি অপহরণকারী চক্র অপহরণ ব্যবসায় নেমেছে। তার মধ্যে মিরাজের গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে গত পাঁচ-ছয় মাসে অন্তত ৫০টি অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা মন্ত্রণালয়, এ দেশীয় ও আমাদের দেশীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বিষয়টি জানিয়েছি। এর মধ্যে র্যাব ৮-এর দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে মিরাজসহ তাদের কয়েকজনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় জানা গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্রুপটিকে ধরতে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি।’
র্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মো. রাকিবুজ্জামান বলেন, ‘লিবিয়াতে এ পর্যন্ত আমরা যতগুলো অপহরণকারী গ্যাং পেয়েছি এদের সবার মাফিয়া ডন বা মূল নেতা মিরাজ। গ্যাংটি খুব ভয়ংকর। তার সঙ্গে যেসব লিবিয়ান সদস্য রয়েছে তাদের নাম আমরা জানতে পারিনি। তবে বাংলাদেশি যে কয়জন সদস্য রয়েছে তাদের নাম ও পরিচয় জানতে পেরেছি। এরা অত্যন্ত ভয়ংকর। এরা হাজার হাজার বাংলাদেশি যুবককে জিম্মি করে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে। এই চক্রের যেসব সদস্য বাংলাদেশে বসে মুক্তিপণের টাকা আদায় করছে তাদের মধ্যে আটজনকে আমরা আটক করেছি। বাকিদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আর এই চক্রের লিবিয়ান সদস্যদের ধরতে লিবিয়ান হাইকমিশন ও আমরা একযোগে কাজ করছি। এ চক্র শনাক্ত করার ফলে আন্তজার্তিকভাবে বহুল আলোচিত এ রুটটি বন্ধে বড় ধরনের ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে।’