রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের বাজেট ঘোষণা
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৭ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। আজ মঙ্গলবার বিকেলে পরিষদের সম্মেলন কক্ষে চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা বাজেট ঘোষণা করেন।
সংস্থাপন ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয় মিলে মোট ১৫টি খাতে ৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় সাত কোটি টাকা বেশি।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় ৫৫ কোটি ৫৫ লাখ এবং সংস্থাপন ব্যয় ১১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে নিজস্ব আয় তিন কোটি এবং সরকারের থোক বরাদ্দ ৬৪ কোটি টাকা।
বাজেট ঘোষণাকালে উপস্থিত ছিলেন পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছাদেক হোসেন, সদস্য হাজি মুছা মাতব্বর, সাধন বিকাশ চাকমা, স্মৃতি বিকাশ ত্রিপুরা, অমিত চাকমা রাজু, রেমলিয়ানা পাংখোয়া, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ত্রিদিব দাশ, সবির কুমার চাকমা, সান্ত্বনা চাকমা, মনোয়ারা জাহানসহ পরিষদের কর্মকর্তারা।
বাজার ও টোল নিয়ে হতাশা
প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার বাজারগুলোর টোল প্রদানকালে ‘সিন্ডিকেটের’ কারণে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো টোলের প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির আয় অর্ধেকের নিচে কমে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন এর চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে বাজেট পেশকালে এই কথা বলেন তিনি।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুনির্দিষ্টভাবে কুতুকছড়ি ও ঘাগড়া বাজারের টোল বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, এই বাজারগুলোতে সিন্ডিকেটের তৎপরতার কারণে জেলা পরিষদের যেখানে ২০ লাখ টাকার বেশি আয় করার কথা, সেখানে মাত্র চার-পাঁচ লাখ টাকা আয় করতে পারছে। তিনি বলেন, একমাত্র বেতবুনিয়া টোল আদায়কেন্দ্র ছাড়া অন্যান্য টোল আদায় কেন্দ্রগুলো থেকেও প্রত্যাশিত আয় করা যাচ্ছে না।
তবু জেলা পরিষদ নিজেদের আয় বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বৃষ কেতু চাকমা।
হস্তান্তরিত বিভাগ নিয়ে ক্ষোভ
বাজেট অধিবেশনে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত বিভাগগুলো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১৯৮৯ সালে যে বিভাগ হস্তান্তর হয়েছে সেই বিভাগের কর্তৃত্ব নিয়েও টানাটানি করে জেলা প্রশাসন। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ ও পর্যটনের কাজ কে করবে এটা নিয়েও টানাহেঁচড়া আছে। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ পালনের জন্য চিঠি এসেছে জেলা প্রশাসকের কাছে, অথচ এই বিভাগ ১৯৮৯ সাল থেকেই জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত। মাধ্যমিক শিক্ষা ও পর্যটন নিয়েও একই ধরনের অবস্থা চলছে বলে মন্তব্য করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পদোন্নতি করায়, জেলা পরিষদ শিক্ষকদের নিয়োগ ও বদলি করতে পারছে না বলেও মন্তব্য করেন চেয়ারম্যান।
এই টানাপড়েনে কার্যক্রমকে গতিশীল করা যাচ্ছে না জানিয়ে বৃষ কেতু চাকমা বলেন, ক্ষমতা একজনের, কাজ করে আরেকজন। এভাবে তো কার্যক্রমে গতি আনা যায় না।
তবে বিষয়টির সুরাহা করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে জানিয়ে চেয়ারম্যান জানান, সভায় বিষয়টি দেখভাল করার জন্য উপস্থিত অতিরিক্ত সচিবকে বলা হয়েছে। আশা করছি এর সুরাহা হবে।
থাকবে না চতুর্থ ও সপ্তম শ্রেণির বৃত্তি
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে পরিচালিত চতুর্থ ও সপ্তম শ্রেণির বৃত্তির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বৃষ কেতু চাকমা বলেন, ‘এই বৃত্তির জন্য একজন শিক্ষার্থীকে এককালীন দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু এই দুই হাজার টাকার জন্য উপজেলা পর্যায় থেকে আসা একজন শিক্ষার্থীর খরচ হয় চার হাজারেরও বেশি। আবার এই বৃত্তির জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের ছয় লাখ টাকা দিলেও আনুষঙ্গিক খরচ হয় আরো আট লাখ টাকা। ফলে আমরা এটি নিয়ে নতুন করে ভাবছি। এই বৃত্তি না রেখে আরো বেশি কীভাবে শিক্ষার্থীদের আর্থিক ও অন্য সহায়তা করা হয়, সেটার দিকেই গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা।’
দুর্যোগে খরচ ২৭ লাখ টাকা
রাঙামাটিতে পাহাড়ধসের ঘটনায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিজেদের তহবিল থেকে ২৭ লাখ টাকা খরচ করেছে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা নিহতদের পরিবারপ্রতি ২০ হাজার টাকা প্রদান করার পাশাপাশি, চারটি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করেছি। রাঙামাটি হাসপাতালে আহতদের ওষুধ খরচ বহন করেছি।’
গত ৩০ জুন পর্যন্ত পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে দুর্যোগকালীন সহায়তা হিসেবে ৮০ টন গম, ২০ টন চাল এবং ৩৭ লাখ টাকা পাওয়া গেছে জানিয়ে চেয়ারম্যান আরো বলেন, লংগদুর ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সাড়ে ১৬ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাজেকে খাদ্যাভাব, লংগুতে অগ্নিদুর্গতদের ও রাঙামাটির পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার পাশাপাশি জেলা পরিষদকে প্রতিদিনই নানা সহযোগিতা করতে হয়। এই সহায়তা করে জেলা পরিষদ এখন ২৯ লাখ দেনা আছে বলেও জানান তিনি।
পর্যটনের মহাপরিকল্পনা
রাঙামাটির পর্যটন উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক্রমে এক হাজার ১৬২ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা তৈরি করে এর ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বৃষ কেতু চাকমা। তিনি জানান, এই পরিকল্পনা প্রণয়নে জেলা পরিষদের ৭১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও পার্বত্য সচিব এই প্রকল্প পাস করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। তারা এই বছরের মধ্যে যদি প্রকল্পটি পাস করাতে পারেন, তবে আগামী বছর থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে এবং রাঙামাটির চেহারা বদলে যাবে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে
ধর্মীয় খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, সারা দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন ধনী লোক নেই, যারা ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সহায়তা করতে পারবেন। ফলে বাধ্য হয়েই পার্বত্য জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ড মসজিদ, মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।
প্রবিধান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে
পার্বত্য রাঙামাটি জেলা পরিষদের প্রয়োজনীয় প্রবিধানগুলোর খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রায় ১০ মাস আগেই বেশ কিছু প্রবিধান আমরা পাঠিয়েছি, যেগুলো বাকি আছে সেগুলোও আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পাঠিয়ে দেব।’ প্রবিধানগুলো কার্যকর হলে জেলা পরিষদ আরো বেশি সক্ষম হবে বলেও জানান চেয়ারম্যান।
‘দুর্যোগে পাশে ছিলাম’
রাঙামাটির পাহাড়ধসের ঘটনায় জেলা পরিষদকে সক্রিয়ভাবে দেখা যায়নি-এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘নির্বাচিত না হলেও আমাদের জবাবদিহিতা আছে মানুষের কাছে। যারা এই অভিযোগ করছে তা সত্যি বলছে না। ১৩ তারিখ সকাল পৌনে ৬টায় আমি নিজে হাসপাতালে গেছি। সেখান থেকে শিমুলতলীসহ দুর্যোগের এলাকাগুলোতে গেছি। আমরা আর্থিকভাবে, বিভিন্ন সহায়তা করে এবং শারীরিকভাবেও মানুষের পাশে ছিলাম।’
বক্তব্যের শেষে ‘আমরাও মানুষ, আমাদেরও ভুল হতে পারে। ভুল হলে ক্ষমা চাই’ মন্তব্য করেন চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা।