গাজীপুর সিটি মেয়র মান্নান ফের বরখাস্ত
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানকে আবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদকের করা এক মামলার অভিযোগপত্র আদালতে গ্রহণ করায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে ফের বরখাস্ত করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. শহীদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানা গেছে। একই প্রজ্ঞাপনে সিটি করপোরেশনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. গোলাম কিবরিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের চার বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে মেয়র এম এ মান্নানের আহ্বান করা করপোরেশনের বৃহস্পতিবারের মাসিক সমন্বয় সভা ও মধ্যাহ্নভোজ অনুষ্ঠান একক সিদ্ধান্ত নিয়ে আহ্বান করার অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলররা তা বর্জন করেছেন। ফলে কোরাম না হওয়ায় ওই সভা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। অপরদিকে, প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ বিকেলে নগর ভবনে মেয়রের কার্যালয়ে আবার ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান দায়িত্ব পালনকালে সিটি করপোরেশনের ত্রাণ ও দরিদ্র তহবিলের আয়গুলো কোনো ব্যাংক হিসাবে না রেখে নিয়মবহির্ভূতভাবে ক্যাশ ইন হ্যান্ড হিসেবে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়ার কাছে রাখেন। তাঁরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ ও টাকা গ্রহীতার স্বাক্ষরবিহীন ৯৯৯টি ভুয়া ভাউচার সৃজন করে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৯ লাখ এক হাজার ৮৪৮ টাকা আত্মসাৎ করেন।
এ মর্মে দুদক গত বছরের ১২ জুন জয়দেবপুর থানায় মামলা করে। মামলার তদন্তকালে সিটি করপোরেশনের ছয় কর্মকর্তা-কমচারীসহ আটজন সাক্ষী সাক্ষ্য-প্রমাণ দেন। ওই মামলায় তদন্ত শেষে প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তিতে গত ১২ জানুয়ারি গাজীপুরের বিশেষ জজ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। পরে ১৮ জানুয়ারি অভিযোগপত্রটি ওই আদালতে গৃহীত হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. গোলাম কিবরিয়াকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। এ নিয়ে অধ্যাপক এম এ মান্নানকে তৃতীয়বার বরখাস্ত করা হলো।
প্রজ্ঞাপনে আরো উল্লেখ করা হয়, যেহেতু অধ্যাপক এম এ মান্নান ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হয়েছে, যা সিটি করপোরেশনের মেয়রের নৈতিক মানদণ্ড ও ভাবমূর্তির পরিপন্থী। এ অবস্থায় মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল ক্ষুণ্ণ হওয়া, সাক্ষ্য-প্রমাণাদি বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রভাবিত হওয়ার যৌক্তিক আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে দিয়ে মেয়রের ক্ষমতা প্রয়োগ জনস্বার্থের পরিপন্থী এবং জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনসেবায় নিয়োজিত থাকা প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমীচীন নয় মর্মে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন মোতাবেক সিটি করপোরেশনের মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে তাঁকে সাময়িক বরখাস্তের বিধান রয়েছে।
এদিকে, ২৮ মাস বরখাস্ত থাকার পর আইনি লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে গত ১৮ জুন মেয়রের চেয়ারে বসেন অধ্যাপক এম এ মান্নান। আজ বৃহস্পতিবার ছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের চার বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে মেয়র মান্নান বৃহস্পতিবার নগর ভবনে মাসিক সমন্বয় সভা আহ্বান এবং মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। কিন্তু ৭৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে অধিকাংশ কাউন্সিলর নগর ভবনে উপস্থিত থাকলেও তাঁরা ওই বৈঠক বর্জন করেন। ফলে কোরাম পূর্ণ না হওয়ায় ওই সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।
বর্জনকারী কাউন্সিলররা জানান, অধ্যাপক মান্নান নাশকতা ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় অভিযুক্ত। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে চার বছর পূর্তি ও মাসিক সভা আহ্বান করেছেন। এ ছাড়া তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাই অধিকাংশ কাউন্সিলর সভা বর্জন করেছেন।
গত ২০১৩ সালের ৬ জুলাই নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। ওই নির্বাচনে ৭৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে বেশির ভাগ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলররা নির্বাচিত হন।
এ ব্যাপারে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ বলেন, ‘মেয়রের অনুপস্থিতিতে এর আগে আমাকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে ওই আদেশ প্রত্যাহার কিংবা দায়িত্ব হস্তান্তর সংক্রান্ত কোনো আদেশ মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত আমাকে দেওয়া হয়নি। নিয়মানুযায়ী আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নতুন আদেশ জারি হওয়ার কথা। কিন্তু অধ্যাপক মান্নান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে এমনকি আমার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে না নিয়ে গত ১৮ জুন তিনি মেয়রের চেয়ারে বসেন। বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে ফের সাময়িক বরখাস্ত করে। যেহেতু ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে আমাকে নিয়োগের আদেশ মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত প্রত্যাহার করেনি, সেহেতু ওই আদেশ অনুযায়ী মেয়রের অনুপস্থিতিতে বর্তমানে আমিই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে মেয়রের দায়িত্ব পালন করব।’
যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলা মামলায় ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এম এ মান্নানকে ঢাকার বারিধারার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় ২৮ মাস কারাগারে ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা রয়েছে। সব কটি মামলায় তিনি জামিন নিয়েছেন। আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি নিয়ে তিনি গত ১৮ জুন মেয়রের চেয়ারে বসেন। মেয়র এম এ মান্নানের অবর্তমানে ২০১৫ সালের ৮ মার্চ থেকে প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন।