মৌলভীবাজারে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারে তৃতীয়বারের মতো ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ২০টির বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া জুড়ী ও কুলাউড়া শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার মানুষ।
ওই এলাকার অধিকাংশ ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বড়লেখার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন উপজেলার প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ।
গত মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে সোনাই, কণ্টিনালা, জুড়ী ও কুশিয়ারা নদী দিয়ে আসা আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলায় এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে খেটে খাওয়া মানুষ সব হারিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এর আগে ২০১৪ সালে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হয়েছিল।
তিন উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের ২০টি, প্রাইমারি ও মাদ্রাসা পর্যায়ে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকেছে। কোনো কোনোটির মাঠ ছাড়াও স্কুলের শ্রেণিকক্ষ, অফিস রুম তলিয়ে গেছে। ঈদের বন্ধ শেষে প্রতিষ্ঠানগুলো রোববার খোলার কথা রয়েছে। অকালবন্যায় যেমন একমুঠো বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেননি। পরে হাওরের মাছের ক্ষতি, সব শেষ আউশ ধান ও আমনের বীজতলার ক্ষতিতে এলাকার কৃষি ও মৎস্যজীবীরা পড়েছেন মারাত্মক ক্ষতিতে।
হাওরপাড়ের তিন উপজেলার মানুষ দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে এলাকার অধিকাংশ ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, ঈদগাহ, মন্দির ও রাস্তাঘাট। অধিকাংশ ঘরবাড়ি দুই থেকে ছয় ফুট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকেই নিজ বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় জুড়ী উপজেলা পরিষদের ভেতরসহ কুলাউড়া পৌর এলাকার তিনটি ওয়ার্ড প্লাবিত হয়েছে।
কুলাউড়ার ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
কুলাউড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বি জানান, কুলাউড়া উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় ৭০-৮০টি গ্রাম এখন পানিবন্দি। তাঁর উপজেলা পরিষদেও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এসব ইউনিয়নের প্রায় ২০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। এর ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগ।
গোলাম রাব্বি আরো জানান, কয়েক দফা ত্রাণ দেওয়া হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। চলমান বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে ঢলে হাকালুকির পানি ক্রমশ বাড়ছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে উঁচু অংশেও এখন দেখা দিয়েছে বন্যা।
কুলাউড়া উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ভুকশিমইল ইউনিয়ন, জয়চণ্ডি, হাজীপুর, কাদিপুর, কুলাউড়া সদর, ব্রাহ্মণবাজার, ভাটেরা ও বরমচাল ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আ ফ ম কামরুল ইসলাম বলেন, মার্চে শুরু হওয়া আগাম বন্যায় এ উপজেলায় ধান, মাছ ও সবজির ব্যাপক ক্ষতির হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এই এলাকাগুলোকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে করে ওই এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। কুলাউড়ায় চারটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
জুড়ীতে পানিবন্দি ৬০ হাজার বাসিন্দা
জুড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিন্টু চৌধুরী বলেন, ‘বিগত ১৫-২০ দিন ধরে এ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে এখন শহরে পানি উঠেছে। বর্তমানে উপজেলা প্রাঙ্গণে প্রায় তিন ফুট পানি। আমার বাংলোর নিচতলায় পানি উঠেছে। সিফট করে দ্বিতীয় তলায় উঠেছি এবং উপজেলা প্রশাসনের সব কাজও হচ্ছে দ্বিতীয় তলায়।’
মিন্টু চৌধুরী জানান, জুড়ীর জায়ফরনগর, পশ্চিম জুড়ি ইউনিয়নসহ ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় ৩৫টি গ্রামের ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন। এ বছর মার্চের মাঝামাঝিতে বন্যা, হাওরের পানি না কমা ও পরে আবার টানা বর্ষণে বন্যা দেখা দিলে মানুষকে একটু বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
ইউএনও আরো জানান, মাইকিং করে, চেয়ারম্যান ও মেম্বারের মাধ্যমে খবর দিয়ে যাদের বাড়িতে পানি উঠেছে তাদের বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে বলা হয়েছে। উপজেলা ও সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ জিআর, ভিজিডি, ভিজিএফের চাল দেওয়া হয়েছে। এখনো ৫০ টন চাল বিতরণ করা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রে পরিদর্শনসহ বন্যা আক্রান্ত এলাকা প্রশাসনের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে।
রাস্তায় নৌকা
গাড়ি চলাচলের রাস্তা দিয়ে নৌকা নিয়ে অফিস করছেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও সরকারি কর্মকর্তারা। আর শহরের বাড়িঘরে স্থায়ী জলাবদ্ধতা জুড়ী ও বড়লেখা শহরের মানুষ বিপাকে।
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান গুলসানারা মিলি জানান, এত পানির অভিজ্ঞতা তাঁর প্রথম। কয়েকদিন ধরে গাড়ি রেখে নৌকায় এসে তাঁকে অফিস করতে হচ্ছে।
বড়লেখায় পানিবন্দি ৯০ হাজার মানুষ
বড়লেখার ১০টি ইউনিয়নে অব্যাহত বন্যায় বর্নি, দক্ষিণবাগ, তালিমপুর ও সুজানগর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। এরই মধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এ উপজেলার প্রায় ৬০টি গ্রামের ৯০ হাজার মানুষ।
প্রতিদিনের বৃষ্টির কারণে হাওরে পানি বাড়ছে। আর নতুন বসতি এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না করার মতো শুকনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে লোকজন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত ভোলারকান্দি গ্রামের খেলারুন বেগম, মনোয়ারা বেগম ও লালী বেগম বলেন, ‘১১ দিন থেকে স্কুলে আছি। গত রাত তুফানে ঘরের টিন হাওরে উড়াইয়া নিয়ে গেছে। খুব বেশি তুফান হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবারের সমস্যায় আছি। আশ্রয়কেন্দ্রে ৫০০ টাকা, লুঙ্গি, সেমাই, চিনি, তেল, কিছু চিঁড়া, মুড়ি ছাড়া এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সাহায্য পাইনি। খুব কষ্টে আছি আমরা।’
তালিমপুর ইউপির চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ কান্তি দাস জানান, তাঁর ইউনিয়নের সবকটি গ্রামের ঘরবাড়ি বন্যায় তলিয়ে গেছে। গত তিনদিন বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও বৃষ্টির কারণে পানি বাড়তে থাকে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। রান্না করে খাওয়ারও কোনো জায়গা নেই। দুর্গত মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে। এখনো তেমন সরকারি সাহায্য মেলেনি।
বড়লেখার ইউএনও এস এম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘প্রতিদিনের বৃষ্টির কারণে হাওরে পানি বাড়ছে আর বসতি এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। তিনটি আশ্রয়কেন্দ্রে এ পর্যন্ত মোট ১১৫টি দুর্গত পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে পরিদর্শন করা হয়েছে। বন্যাদুর্গতদের জন্য ৩৯ মেট্রিক টন জিআর চাল ও জিআর ক্যাশ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এগুলো দ্রুত বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আরো বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বড়লেখা ও জুড়ী আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ এম সাহাব উদ্দিন বলেন, কয়েক দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগ পড়েছে মৌলভীবাজারে। এরই মধ্যে জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় সরকারি ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আগামীতে আরো ত্রাণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ওপরে
এদিকে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে রাজনগর উপজেলার কাউয়াদিঘি হাওরের পানি নামতে না পারায় প্রায় ১০টি গ্রামের অন্তত ১০ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। আর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে রাজনগর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের অন্তেহরি গ্রাম। একই কারণে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখাইলকুড়া ইউনিয়নের কাদিপুর, নাজিরাবাদ ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, বড়লেখা, কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার সানাই, কন্টিনালা, জুড়ী নদী ও শতাধিক পাহাড়ি ছড়া দিয়ে হাকালুকিতে বৃষ্টির পানি নামে। এসব ছড়া দিয়ে ভারতের পানিও নামে। আর হাকালুকি হাওরের পানি কুশিয়ারা নদী দিয়ে বের হয়। বর্তমানে কুশিয়ারা নদীর যে স্থান দিয়ে পানি নামে সেখানে বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তাই পানি বের হতে না পেরে পানিতে ফুলে গিয়ে এই তিন উপজেলার গ্রামগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। কুশিয়ার পানি নেমে গেলে তখন অন্তত শহর ও শহরতলির পানি নেমে যাবে।