বিদেশি রেডিওতে নৃশংস হত্যার বর্ণনা, র্যাবের অস্বীকার
অনলাইন ডেস্ক
‘তাকে খুঁজে পেলেই গুলি করে মেরে ফেল। যেখানেই পাও না কেন। এরপর তাঁর পাশে একটি অস্ত্র রেখে দিও।’
-বক্তব্যটি কোনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গি নেতার নয়। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যটালিয়নের (র্যাব) সদস্যদের এমন নির্দেশ দেন বাহিনীটির কর্মকর্তারা। ‘সুইডিশ রেডিও’ নামে সুইডেনের একটি রেডিও চ্যানেল এক প্রতিবেদনের এ দাবি করেছে।
রেডিও চ্যানেলটি ‘র্যাবের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথোপকথনের’ একটি অডিওর কিছু অংশ গত মঙ্গলবার একটি প্রকাশ করে। ওই অডিওতে ‘র্যাব কর্মকর্তার’ মুখ থেকে শোনা যায় ‘র্যাবের বিভিন্ন নৃশংসতার’ কথা। মূল অডিওটি প্রায় দুই ঘণ্টার এবং এটি গোপনে ধারণ করা হয়। ওই কর্মকর্তার পরিচয় গোপনের জন্য ইলেকট্রনিকভাবে কণ্ঠস্বরও পরিবর্তন করা হয়েছে।
কী আছে ওই অডিও কথপোকথনে
অডিও কথপোকথনে র্যাবের ওই কথিত কর্মকর্তা জানান, অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে তিনি জড়িত আছেন। মারাত্মক কোনো অপরাধের পরও যদি কেউ আইনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় বা সৎপথে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব মনে হয় তখনই তাকে হত্যা করে র্যাব।
অডিওতে বলা হয় কীভাবে পুলিশ সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়। ওই টাকা দিয়ে অস্ত্র কেনা হয়। তারপর সেই অস্ত্র হত্যাকাণ্ডের পর মরদেহের পাশে রেখে মিথ্যা গল্প সাজানো হয়।
অডিওতে খুন, অপহরণ ও গুমের বিষয়ে কথা বলেছেন ‘র্যাব’-এর ওই কর্মকর্তা। বলা হয়, প্রথমে র্যাব লক্ষ্য ঠিক করে। তারপর লক্ষ্যবস্তু যখন চায়ের দোকানে বসে থাকে বা সাধারণ কাজে ব্যস্ত থাকে, তখন তাদের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে আটক করা করা হয়।
কথোপকথনের একপর্যায়ে কথিত ওই ‘র্যাব কর্মকর্তা’ বলেন, অনেকের কাছেই অস্ত্র থাকে। আবার অনেককে খুন করার পর পাশে অস্ত্র রেখে দেওয়া হয়। এতে হত্যার একটি কারণ জানাতে পারে র্যাব।
গুমের ক্ষেত্রে র্যাব তিনটি ধাপে কাজ করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই অডিওটিতে। বলা হয়, প্রথমে কাউকে আটক করে র্যাব। তারপর তাকে হত্যা করা হয়। সবশেষে লাশ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। লাশ লুকিয়ে ফেলতে মাঝে মাঝে কংক্রিট বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
কাউকে হত্যা করার আগে তাকে পরিচিতজন বা নিরাপদে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। পরে গোপন কোনো স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করেন ‘র্যাব’-এর ওই কর্মকর্তা।
হত্যার পর কীভাবে প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করা হয় তা নিয়েও কথা বলা হয়েছে অডিওটিতে। কথোকথনের একপর্যায়ে বলা হয়, ‘গুমের বিষয়ে সবাই দক্ষ নয়। আমাদের নিশ্চিত করতে হয় যেন কোনো প্রমাণ না থেকে যায়। কোনো পরিচয়পত্র যেন ঘটনাস্থলে পড়ে না থাকে। আমাদের হাতে গ্লাভস (হাতমোজা) পরতে হয়। আমরা পায়ের ছাপ রেখে যাই না। এ ছাড়া এমন অভিযান চালানোর সময় ধূমপানও নিষিদ্ধ।’
প্রতিদিন এভাবেই অনেক মানুষ হারিয়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই নাকি নিরপরাধ। প্রয়োজনবশে যে কাউকেই হত্যা করা হতে পারে। একইভাবে সরকারের রাজনৈতিকবিরোধীদেরও হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
র্যাবের নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়, অন্ধকার ঘরের মধ্যে একটি বাতি জ্বালিয়ে আটক ব্যক্তিকে নগ্ন অবস্থায় উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তার হাতে হাতকড়া পরানো থাকে। এরপর ওই ব্যক্তির অণ্ডকোষে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এতে অণ্ডকোষ ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে তারা। সে সময় বোঝাও যায় না তারা জীবিত না মৃত।
নৃশংস ওই বর্ণনা দিতে দিতে কথিত র্যাব কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।
র্যাবের অস্বীকার
ফাঁস হওয়া ওই অডিওটি নিয়ে বিদেশের পাশাপাশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও। তবে ওই অডিওটি একেবারেই ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছে র্যাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের একজন মুখপাত্র বিবিসি বাংলাকে বলেন, সুইডিশ রেডিওর ওই রেকর্ডিং ভুয়া।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তথাকথিত ওই র্যাব কর্মকর্তার কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি, তাঁর কণ্ঠ বিকৃত করা হয়েছে। আর তা ছাড়া র্যাবের কোনো কর্মকর্তা এ ধরনের নির্দেশ দিতে পারেন না।’
বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে জানান, সুইডিশ রেডিওর প্রকাশ করা অডিও কথোপকথনটি যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলো বরাবরই র্যাবের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করে আসছে। র্যাব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে বলে দাবি করে তারা।
বাংলাদেশের এ ধরনের ঘটনাগুলো বেশ কিছুদিন ধরে পর্যবেক্ষণে রেখেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামিনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এ ছাড়া র্যাবের হাতে নিহত, গুম বা নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ আছে, এমন পরিবারগুলোর সঙ্গেও তারা সব সময় যোগাযোগ রেখেছে।
অডিও কথোপকথনটি বেদনাদায়ক বলে উল্লেখ করেছেন অ্যামিনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ওলোফ ব্লমকোভিস্ট। তিনি বলেন, ‘এমন মারাত্মকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে কেউ এতটা ঠান্ডা মাথায় ও সাবলীলভাবে বর্ণনা দিতে পারে তা শুনলে গা শিউরে ওঠে। আমরা বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত নই। তবে এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।’
ব্লমকোভিস্ট আরো বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে গুমের সংখ্যা আকাশ ছুঁয়েছে। এটা খুবই বড় সমস্যা। খুন-গুম হওয়া অনেকেই সমাজকর্মী অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। এ দেশের কেউ নিরাপদে নেই।’
‘এটি আরো খতিয়ে দেখা উচিত। অন্যদিকে, আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের দমনে বিচার ব্যবস্থাকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সরকারের নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন ব্লমকোভিস্ট।
‘অডিওতে আমরা যা শুনতে পাই তার সঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অন্য মানবাধিকার সংস্থার বিগত কয়েক বছরে সংগ্রহ করা র্যাব সংক্রান্ত তথ্যের মিল রয়েছে।’
র্যাব বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ড চালায় বলে উল্লেখ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তবে র্যাবের দাবি নিজেদের রক্ষার্থে ওই নিহতের ঘটনাগুলো ঘটেছে।
