মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তার অনিয়ম, তদন্তে গড়িমসি
সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের ব্যক্তিগত সহকারী মো. সহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হুন্ডি ব্যবসা, সই জালসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। তথ্য মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিল জাতীয় সংসদে তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। প্রায় তিন মাস হয়ে গেলেও সহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবেদন দেয়নি মন্ত্রণালয়।
স্থায়ী কমিটির অষ্টম বৈঠকে বলা হয়, পরবর্তী নবম বৈঠকে এ প্রতিবেদন জমা দেবে মন্ত্রণালয়। গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত দশম বৈঠকেও মন্ত্রণালয় কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য। মন্ত্রণালয় স্থায়ী কমিটিকে জানিয়েছে, অভিযুক্ত সহিদুল ইসলাম এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। সহিদুলকে দেশে ফিরিয়ে এনে তদন্ত করলে লাখ লাখ টাকা খরচ কবে। তাঁকে সেখানে রেখেই তদন্ত করতে চায় তথ্য মন্ত্রণালয়।
সাবেক তথ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) ও বর্তমানে ওয়াশিংটন দূতাবাসের কর্মকর্তা মো. সহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হুন্ডি ব্যবসাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নবম বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির বৈঠকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনো মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পরবর্তী বৈঠকে আবারও কমিটিতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
সাবেক তথ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সহিদুল ইসলামের অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন গত ১৮ মার্চ প্রদান করতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো রবিউল ইসলামকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছিল। সংসদীয় কমিটির নবম বৈঠকের কার্যপত্রে উল্লেখ আছে, সাবেক তথ্যমন্ত্রীর পিও সহিদুল ইসলামকে বর্তমান কর্মস্থলে রেখেই পুনঃতদন্ত করে প্রতিবেদন পরবর্তী অর্থাৎ দশম বৈঠকে উপস্থাপন করার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত দশম বৈঠকেও তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে কমিটির তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আজকের বৈঠকেও সরাসরি তদন্ত (ডাইরেক্ট ইনকোয়ারি) করে দেখার জন্য উপসচিব ও তথ্যসচিবকে সময় দেওয়া হয়েছে। আগামী বৈঠকে তাঁরা এটি কমিটিতে দাখিল (সাবমিট) করবেন।
তদন্ত কমিটি গঠনের পরও প্রতিবেদন জমা না দেওয়া প্রসঙ্গে এ কে এম রহমতুল্লাহ বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি, তারা এটি তদন্ত করবে। আমরা তো আর তদন্ত কমিটি করতে পারব না। এটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়।’
কমিটির নবম বৈঠকে সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. সহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না প্রশ্ন উত্থাপন করেন কমিটির সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ। কিন্তু মন্ত্রণালয় বরাবরের মতো তদন্ত চলছে বলে জানায়। এর আগে গত ১৪ জানুয়ারি কমিটির সপ্তম বৈঠকে বিষয়টি প্রথম আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে তাঁকে ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে ফিরিয়ে এনে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। তদন্তসাপেক্ষে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তথ্যমন্ত্রী। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর প্রতিটি বৈঠকেই ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়।
সহিদুলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
এ বিষয়ে কমিটির নবম বৈঠকে কমিটির সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ বলেন, সহিদুল ইসলাম দিল্লিতে থাকাকালীন হুন্ডি ব্যবসা করতেন। কিন্তু এ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে এর আগে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
তিনি ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হয়েও দূতাবাসের প্যাডে মিনিস্টার (প্রেস) হিসেবে সহি (সই) করেছেন।’ এ ব্যাপারে বিভিন্ন দলিল আছে বলে সুকুমার উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের গৃহীত কার্যক্রম যথাযথ হয়নি।’ বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সুকুমার রঞ্জন ঘোষ আরো বলেন, ‘সহিদুল বরিশালের লোক হওয়া সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জের কোটায় চাকরি নিয়েছেন।’ এ ব্যাপারে পুলিশের যাচাই করা তথ্য (ভেরিফিকেশন রিপোর্ট) তাঁর কাছে আছে বলে জানিয়েছেন সুকুমার। ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে ফিরিয়ে এনে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবারও প্রস্তাব করেন তিনি।
সুকুমার রঞ্জন ঘোষের এ অভিযোগের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সচিব মরতুজা আহমদ ওই বৈঠকে জানান, ‘বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন (রিপোর্ট) প্রদানের জন্য উপসচিব রবিউল ইসলামকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে।’ মরতুজা আরো বলেন, ‘যেহেতু সরকারি চাকরি করেন সেহেতু তাঁকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে তদন্ত করা হলে তাঁকে যাতায়াত ভাতা প্রদান করতে হবে এবং তাতে লাখ লাখ টাকা লাগবে।’ তিনি সহিদুলকে কর্মস্থলে রেখেই তদন্ত কাজ চালানো যাবে জানান। স্থায়ী কমিটির সদস্য তারানা হালিমও প্রস্তাব সমর্থন করেন।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এ ব্যাপারে বলেন, বর্তমান কর্মস্থলে রেখেই বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা যেতে পারে। দোষী সাব্যস্ত হলে সহিদুলকে প্রত্যাহার করা যেতে পারে বলে তিনি জানান।
গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, মৃণাল কান্তি দাস ও তারানা হালিম অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া তথ্যসচিব মরতুজা আহমদ, তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি)-এর প্রধান তথ্য কর্মকর্তা তছির আহম্মদ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক আবদুল মান্নান, গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কামরুন্নাহার, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) মহাপরিচালক মো. লিয়াকত আলী খানসহ তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।