৭ মার্চের ভাষণ : কালের সাক্ষী ‘কল-রেডী’
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন এই ঘোষণা দিচ্ছিলেন তার সম্প্রচার হচ্ছিল ‘কল-রেডী’ মাইকের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই ‘কল-রেডী’ মাইক সার্ভিসের নাম। শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়; হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেকেই ‘কল-রেডী’র মাইক ব্যবহার করে বক্তব্য দিয়েছেন।
বিদেশি নেতাদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ‘কল-রেডী’ মাইক্রোফোনে ভাষণ দেন বলে জানা গেছে।
পুরান ঢাকার ‘কল-রেডী’ নামটি কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশেও ‘কল-রেডী’র মাইকে বক্তব্য দিয়েছেন নেতারা।
‘কল-রেডী’র ইতিহাস
এখনো ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হরহামেশাই ‘কল-রেডী’র ডাক পড়ে। মাইক শব্দটি কানে এলেই সবার মনে পড়ে ‘কল-রেডী’র কথা। পুরান ঢাকার ৩৬ ঋষিকেশ দাস লেনে রয়েছে ‘কল-রেডী’র আদি কার্যালয়। বর্তমানে এখানে ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
১৯৪৮ সালে সূত্রাপুরের দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ মিলে একটি দোকান চালু করেন। নাম ‘আরজু লাইট হাউস’। লাইট হাউস নাম হলেও লাইটের পাশাপাশি গ্রামোফোনও ভাড়া দেওয়া হতো। বিয়ে-শাদিতে লাইটের সঙ্গে গ্রামোফোনও ভাড়া নিত লোকজন। দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে অল্প দিনেই। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে আসেন দুই ভাই। তাতেও কুলাচ্ছিল না। হরিপদ ঘোষ মাইকের ব্যালেন্স জানতেন। যন্ত্রপাতি কিনে এনে নিজে কয়েকটি হ্যান্ডমাইক তৈরি করেন।
দেশ ভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে নানা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মাইক ভাড়া নিতে শুরু করেন ‘আরজু লাইট হাউস’ থেকে। চাহিদা বাড়তে থাকে দিনে দিনে। তাই তাইওয়ান, জাপান, চীন থেকে আনা হয় মাইক। তবে মাইকের মূল অংশ মানে ইউনিট বেশি আনা হতো বাইরে থেকে। এরপর নিজের দোকানের কারিগর দিয়ে হরিপদ ঘোষ তৈরি করিয়ে নিতেন হর্নসহ বাকি অংশ।
‘কল-রেডী’ নামকরণ
ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সভা-সমাবেশ বেড়ে যায়। এ ছাড়া সামাজিক আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও মাইক ভাড়া যাচ্ছিল। তাই মাইক সার্ভিসের নাম দেওয়ার চিন্তা করলেন দুই ভাই। অবশেষে দয়াল ঘোষ নামটি ঠিক করেন, ‘কল-রেডী’। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, মানুষ তো কাজের জন্যই আমাদের কাছ থেকে মাইক ভাড়া নেয়। তারা কল করলে আমরা যেন রেডি থাকি। এক কথায়, কল করলেই রেডী। সে থেকে নামকরণ হয় ‘কল-রেডী’।
‘কল-রেডী’র বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে ‘কল-রেডী’ রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কনসার্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বা বিয়েতে মাইকের পাশাপাশি সাউন্ড সিস্টেম সরবরাহ করে থাকে। সার্বক্ষণিক সেবার জন্য রয়েছে ২০ জন কর্মী। চাহিদা বেশি হলে অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। ‘কল-রেডী’ এখন একই দিনে তিনটি মহাসমাবেশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সামর্থ্য রাখে বলে জানালেন কর্তৃপক্ষ।