হুমায়ূন আহমেদের ৭১তম জন্মবার্ষিকী আজ
গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার কথকতা তিনিই শুনিয়েছিলেন সবাইকে। আকাশে ভরাট চাঁদ দেখলে প্রায়ই ছুটে যেতেন প্রিয় নুহাশপল্লীতে। তাঁর প্রিয় দীঘি লীলাবতি কিংবা সন্তানতুল্য বৃক্ষরাজির সান্নিধ্যে গিয়ে চন্দ্রবিলাস করতেন। গত কয়েক দিন আকাশে কার্তিকের হিম চাঁদ উঠছে। এ চাঁদ বড্ড প্রিয় ছিল নন্দিত নির্মাতা, কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের। ইট-পাথরের শহর ছেড়ে অনেক দিন ধরেই নুহাশপল্লীর সেই প্রিয় লিচুতলায় শায়িত আছেন তিনি। জীবনভর নুহাশপল্লীর গাছ, দীঘি লীলাবতি কিংবা সোঁদা মাটির গন্ধকে ভালোবেসে যাওয়া খ্যাতিমান এ ব্যক্তিত্বের আজ ৭১তম জন্মদিন।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর পিতার নাম ফয়জুর রহমান। মা আয়েশা ফয়েজ। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন। হুমায়ূন আহমেদের অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিজ্ঞান-শিক্ষক এবং কথাসাহিত্যিক; সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক ও কার্টুনিস্ট।
১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরপরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে যায় চারদিকে। তাঁর সৃষ্ট ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ চরিত্র তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সী পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে অনুসরণীয়। এ ছাড়া দেশে এমন মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা, যাঁরা তাঁর নাটক দেখেননি। হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে—নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, লীলাবতী, কবি, সৌরভ, নী, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, সাজঘর, বাসর, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প, মধ্যাহ্ন প্রভৃতি।
নব্বই দশকের শুরুতে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে তাঁর। নিজের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে হুমায়ূনের পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, ঘেটুপুত্র কমলা। আগুনের পরশমণি, দারুচিনি দ্বীপ ও ঘেটুপুত্র কমলা চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্যজীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার অন্যতম। দেশের বাইরেও সম্মানিত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। জাপানের এনএইচকে টেলিভিশন তাঁকে নিয়ে ‘হু ইজ হু ইন এশিয়া’ শিরোনামে ১৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র প্রচার করে।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এই দম্পতির তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ হুমায়ূন। অন্য আরেকটি ছেলে অকালে মারা যায়। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে শীলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় এবং ওই বছরই শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাঁদের তিন ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর অন্ত্রে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই কোটি বাঙালিকে কাঁদিয়ে মৃত্যুবরণ করেন হুমায়ূন আহমেদ।
তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।