হামলার জন্য হলি আর্টিজানকে টার্গেটের কারণ
নব্য জেএমবি সংগঠনটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস দ্বারা অনুপ্রাণিত। আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করা প্রয়োজন। এ জন্যই জঙ্গিরা হলি আর্টিজানে হামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ মামলার আসামি আসলাম হোসেন র্যাশ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা উল্লেখ করেছে বলে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।
অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, কৌশলী পরিকল্পনায় গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। আর এ হামলার ছক তৈরি করা হয় গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া বাজারের কলেজ মোড়সংলগ্ন সাখাওয়াত হোসেন শফিক ও বাইক হাসানের ভাড়া বাসায়। এর আগে হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা গৃহীত হয় কয়েক স্তরে। হামলার পরিকল্পনার প্রথম অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে বোনারপাড়া বাজারের ভাড়া বাসায় তামীম আহমেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, সরোয়ার জাহান, রায়হানুল ইসলাম রায়হান, নুরুল ইসলাম মারজান, শরিফুল ইসলাম খালেদ, জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজিব গান্ধী একত্র হয়ে বৈঠক করে।
অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, বৈঠকে তারা গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, এ হামলায় দেশি-বিদেশিদের হত্যার মূল সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করবে তামীম আহমেদ চৌধুরী। এ বিষয়ে মামলায় গ্রেপ্তার রাজিব গান্ধী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে।
অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের মার্চ মাসের দিকে তামীম আহমেদ চৌধুরী ও শরিফুল ইসলাম খালেদ কল্যাণপুরে আসলাম হোসেন র্যাশের বাসায় আসে। তখন আসামিরা রমজান মাসে ঢাকার ডিপ্লোম্যাটিক এলাকায় একটা বড় ধরনের আক্রমণ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। আসলাম তখন তামীম আহমেদ চৌধুরীর কাছে গুলশান বা কূটনৈতিক এলাকায় আক্রমণের উদ্দেশ্য জানতে চায়। তামীম চৌধুরী তখন বলে, নব্য জেএমবি সংগঠনটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস দ্বারা অনুপ্রাণিত। আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করা প্রয়োজন। তামীম আরো বলে, সংগঠনের সিদ্ধান্ত তার নেতৃত্বে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে নিয়ে আক্রমণ করতে হবে। এরপর হলি আর্টিজানে হামলার সিদ্ধান্ত তারাই গ্রহণ করে। হামলার পরিকল্পনায় আসলাম হোসেন র্যাশ ও শরিফুল ইসলাম খালেদ সমর্থন দেয়। এসব বিষয় এ মামলায় গ্রেপ্তার আসামি র্যাশ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, ২০১৬ সালের মে মাসে জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবদুস সবুর খান নব্য জেএমবিতে যোগদান করে। এরপর রমজান মাসের প্রথম দিকে তামীম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় আসে। সংগঠনের হাত ধরে মিরপুর এলাকায় একটি বাসায় ওঠে। সে বাসায় রাতে তামীম চৌধুরী ও বাশারুজ্জামান চকলেট তাকে আকিদা ও মানহাজ বিষয়ে ইন্টারভিউ নেয়। তারা সন্তুষ্ট হয়ে সবুর খানকে নব্য জেএমবির শূরা সদস্য মনোনীত করে। নব্য জেএমবির শূরা সদস্যরাই সব ধরনের হামলার অনুমোদন দিয়ে থাকে। সে হিসেবে তামিম চৌধুরী ও বাশারুজ্জামান চকলেট, সবুর খান ও অন্যরা হলি আর্টিজান বেকারিতে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। হামলার জন্য লোক সংগ্রহ, অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহ করার জন্য সবুর খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। থ্রিমা আইডি খুলে ব্লু-স্কাই আইডিতে নব্য জেএমবির মারজান ও হাদিসুর রহমান সাগরসহ অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবুর খান হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা সফল করার জন্য পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে, যা আবদুস সবুর খান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে বলে অভিযোগত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা মামলায় বুধবার রায় ঘোষণা করবেন আদালত। গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান এ রায়ের দিন নির্ধারণ করেন। বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করে আদালতের সরকারি কৌঁসুলি গোলাম সারওয়ার খান (জাকির) বলেন, ‘কারাগারে থাকা ছয় আসামির উপস্থিতিতে এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।’
কারাগারে থাকা ছয় আসামি হলো জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান ও হাদিসুর রহমান সাগর। এ ছাড়া এ মামলায় শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন পলাতক রয়েছে।
আলোচিত এ মামলায় গত বছরের ২৬ নভেম্বর মামলাটির বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল। এর আগে গত বছরের ২৩ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজন আসামি বিভিন্ন অভিযানে ও পাঁচজন হলি আর্টিজানে অভিযানের সময় নিহত হয়েছে। এ ছাড়া জীবিত আটজনের মধ্যে ছয়জন কারাগারে ও বাকি দুজন পলাতক। অভিযানে নিহত পাঁচ জঙ্গি হলো রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
এ ছাড়া বিভিন্ন ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযানে নিহত আটজন হলো তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় বন্দুকধারীরা। হামলার পর রাতেই তারা ২০ জনকে হত্যা করে। সেদিনই উদ্ধার অভিযানের সময় বন্দুকধারীদের বোমার আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হয় পাঁচ হামলাকারী। এ ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ।
জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করে। সংগঠনটির মুখপত্র ‘আমাক’ হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে বলে জানায় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ তাদের দাবি অস্বীকার করে জানায়, আইএস নয়, নব্য জেএমবির সদস্যরা এ হামলা চালিয়েছে।