সড়কে থেমে গেল জীবনের দৌড়, এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন
রেশমা নাহার রত্না সুন্দর গিটার বাজিয়ে চমৎকার গান করতেন। ভালোবাসতেন পাহাড়-পর্বতে চড়তে। স্বপ্ন দেখতেন এভারেস্ট জয়ের। ভালোবাসতেন বই পড়তে, দৌড়াতে, সাইকেল চালাতে।
সেই রত্নার জীবনের সব দৌড় থেমে গেছে। আজ শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে সাইকেল চালিয়ে রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় সরকারি কোয়ার্টারের বাসায় ফেরার পথে গাড়ির চাপায় নিহত হয়েছেন তিনি। সংসদ ভবন ও চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝের রাস্তা ধরে এগোচ্ছিলেন তিনি। চন্দ্রিমাতে ঢোকার ব্রিজটার ওখানে পৌঁছানোর পরই একটা গাড়ি তাঁকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়।
বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার কে এ শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, আজ সকাল ৯টার দিকে সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যানসংলগ্ন লেক রোড দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় একটি প্রাইভেটকার রেশমা নাহার রত্নাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।’
কে এ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘চাপা দেওয়া প্রাইভেটকার ও এর চালকের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করছি।’
নিহত রেশমা নাহার রত্না একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনের সন্তান। তিনি লোহাগড়া আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইডেন কলেজ থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক পাস করেন। পর্বতারোহণের ওপর তিনি ভারতের উত্তরাখন্ডের উত্তরকাশিতে অবস্থিত নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে বি.এমসি কোর্সে পড়াশোনা করেন।
এদিকে, রেশমা নাহার রত্নার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের সাইক্লিং, হাইকিং ও ট্রাভেলিং জগতে শোক বিরাজ করছে। তারা রত্নার মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
অনু তারেক নামের একজন তাঁর ফেসবুকে লিখেন :
আমাদের দীর্ঘ সময়ের বন্ধু, সহযাত্রী পর্বতারোহী রত্না আর নেই। রেশমা নাহার রত্না আজ সকালে হাতিরঝিলে প্রাত্যহিক দৌড় ও ব্যায়াম শেষে সাইকেলে ফেরার পথে সংসদ ভবন ও চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝের (সড়কে) সকাল ৯টার দিকে এক প্রাইভেট গাড়ির সঙ্গে দুর্ঘটনায় এই অপার সম্ভাবনাময়ী মানুষটার জীবন থেমে যায়। ঘাতক গাড়ির কোনো খোঁজ মেলে নাই।
রত্না পেশায় একজন শিক্ষিকা ছিলেন। দীর্ঘদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, দেশে-বিদেশে বেশ কটি হাফ-ম্যারাথন দৌড়ানোর পর নিজেকে ফুল ম্যারাথনে দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত করছিলেন। উনি ভারতের উত্তরকাশিতে অবস্থিত নেহরু মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে তিনবার পর্বতারোহণ নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বেসিক ও অ্যাডভ্যান্স কোর্স সম্পন্ন করে নানা অভিযানে অংশ নেন।
বাংলাদেশে পতাকা নিয়ে আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু দুই পর্বত কিলিমাঞ্জারো ও মাউন্ট কেনিয়া জয়ের মানসে যাওয়ার পর মাউন্ট কেনিয়া শিখর জয়ের পরপর কিলিমাঞ্জারো অভিযানের জন্য তাঞ্জানিয়া সীমান্তে গেলে তাঁকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বাংলাদেশি পাসপোর্টে পোর্ট এন্ট্রিজনিত সমস্যার কারণে। এ ছাড়া তিনি লাদাখের স্তোক কাংরি শিখরে সফল আরোহণ করেন। স্বপ্ন দেখতেন এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়ানোর।
আজ ভোর পৌনে ৬টার দিকে আমাদের দৌড়বিদ বন্ধুদের দলের সঙ্গে রত্নার দেখাও হয় হাতিরঝিলে এবং দৌড় শেষে সবাই যখন আখতার ভাইয়ের Syed Akhteruzzaman বাড়ি থেকে ফ্লাস্কে করে আনা চা পান করছিলেন, রত্নার জন্য একটি কাপ এবং চা আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল। সেই অপেক্ষা আর কোনো দিন শেষ হবে না।
একজন মৃদুভাষী, প্রথাবিরোধী, দৃঢ়চেতা, স্বপ্নবাজ মানুষের এমন অকাল প্রস্থান মেনে নেওয়া যায় না।
রত্না আড্ডায় সুন্দর গিটার বাজিয়ে চমৎকার গান করতেন। এমন অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।
আমরা আর কী বলব!