সোনালিতে স্বপ্নভঙ্গ, প্রাণিসম্পদ অফিসের দাওয়াই ‘সান্ত্বনা’
একসময় ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির খামার করে সর্বস্বান্ত হওয়া কিশোরগঞ্জের ভৈরব-কুলিয়ারচরের পোলট্রি খামারিরা আশা নিয়ে সোনালি মুরগির খামার গড়ে তুলেছিলেন। দেখতে দেশি জাতের মতো এই মুরগির বাজারদর ভালো হওয়ায় ব্যবসাও হচ্ছিল বেশ। তাই শত শত খামারি নবউদ্যমে গড়ে তুলেছিলেন এই সোনালি মুরগির খামার। ফলে দুটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পাঁচ শতাধিক খামার গড়ে ওঠে। কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় বহু শ্রমিকের। আমিষ উৎপাদকদের এই কর্মযজ্ঞে এখানকার অর্থনীতিও বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
কিন্তু প্রকৃতি বুঝি এবারও খামারিদের অনুকূলে থাকল না। বার্ড ফ্লু, রানিক্ষেত ও গাম্বুরি রোগে আক্রান্ত হয়ে শত শত খামারে মড়ক লেগে তাঁদের সেই সোনালি স্বপ্ন ভেঙে যায়। আর বন্ধ হওয়া খামারের উদ্যোক্তারা পুঁজি হারিয়ে, ঋণের চাপে বাড়িঘর ছেড়ে এখন ফেরারি।
পোলট্রি ডিলাররা বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে খালি চেকের মাধ্যমে বাচ্চা, খাবার আর ওষুধ এনেছিলেন। সেগুলো তাঁরা খামারিদের বাকি দিয়েছিলেন। এখন কোম্পানির মামলায় পোলট্রি ডিলারদের কেউ জেলে, কেউ বা সহায়সম্বল বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর যাঁদের স্থাবর সম্পদ নেই, তাঁরা চেকের মামলা থেকে বাঁচতে আদালতে দৌড়ঝাঁপ করছেন।
তবে এর জন্য খামারিরা ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে চিকিৎসক না থাকাকেও দায়ী করেছেন। যদিও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলছেন, ‘আমরা এখন খামারিদের সঙ্গে সান্ত্বনামূলক ব্যবহার করে যাচ্ছি।’
ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের ছাগাইয়া গ্রামের সোনালি মুরগির খামারি মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি ঋণ-ধার করে পাঁচ হাজার মুরগি নিয়ে দুটি শেডে খামার গড়ে তুলেছিলেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তাঁর খামারটি রোগে আক্রান্ত হয়। তিনি তখন মরা মুরগি নিয়ে ছুটে যান উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে পরীক্ষার জন্য। কিন্তু গিয়ে দেখেন সেখানে চিকিৎসক নেই। পরে বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে কয়েক হাজার টাকার ওষুধ কিনে খাওয়ালেও তার খামারের মুরগিগুলো আর সুস্থ করা যায়নি। মরে সব সাফ হয়ে যায়। ঋণদাতাদের চাপে তিনি এখন আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। উপজেলা সদরে যেতে পারছেন না ডিলারের দোকানে বাকি থাকায়।
একই গ্রামের খামারি ও আগানগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. হুমায়ূন মিয়া জানান, তাঁর খামারে তিনি পাঁচ হাজার ১০০ মুরগির বাচ্চা ওঠান। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ২৬ দিন বয়সী মুরগিতে রোগ দেখা দেয়। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকার ওষুধ কিনে খাওয়ালেও কোনো কাজ হচ্ছে না। বর্তমানে প্রতিদিন তাঁর খামারে এক থেকে দেড়শ মুরগি মরছে। এরই মধ্যে হাজারখানেক মুরগি মরে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এইভাবে চলতে থাকলে খামার টিকিয়ে রাখতে পারব না।’
উপজেলার শিমূলকান্দি ইউনিয়নের রাজনগর গ্রামের খামারি সুলতান খন্দকার জানান, তিনি আড়াই হাজার বাচ্চা নিয়ে সোনালি মুরগির খামার করেন। তাঁর খামারেও প্রতিদিনই মরছে মুরগি। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ এনে মুরগিকে খাওয়ালেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তিনি অবিলম্বে ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে ভেটেরিনারি সার্জন নিয়োগ দিয়ে তাঁদের এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার আবেদন জানান।
একই গ্রামের মো. হানিফ মিয়া জানান, আড়াই হাজার করে মুরগির দুটি খামার ছিল তাঁর। জানুয়ারির শুরুতে তাঁর খামারে রোগ মহামারি আকারে দেখা দেয়। তখন তিনি একটি খামারের মুরগি বিক্রি করে দেন। এতে তাঁর দুই লাখ টাকা লোকসান হয়। বর্তমানে যে খামারটি আছে, সেটি থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি করে মুরগি মরছে। তিনি এই খামারটি নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন বলে জানালেন।
কুলিয়ারচর উপজেলার সালুয়া ইউনিয়নের দড়িগাঁও গ্রামের খামারি সুজন মিয়া জানান, ২৮ দিন আগে তিনি তাঁর খামারে পাঁচ হাজার মুরগির বাচ্চা তোলেন। বাচ্চার বয়স ২১ দিন হলে রোগে ধরা শুরু হয়। বর্তমানে প্রতিদিন এক থেকে দেড়শ করে মুরগি মরছে। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ খাওয়ানোর পরও মরা কমছে না।
একই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের খামারি, মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর খান জানান, তিনি ২০ বছর ধরে এই পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে এখানকার পোলট্রিশিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উল্লেখ করে তিনি জানান, তিনি তাঁর খামারে চার হাজার সোনালি মুরগির পেরেন্ট তুলেছিলেন। মুরগিগুলো ডিম দেওয়া শুরু করার পরই মহামারি আকারে বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হয়। ফলে সব মুরগি মরে যায়। এতে করে তাঁর ৪০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। এ ছাড়া তিনি যেসব খামারির কাছে বাচ্চা সরবরাহ করতেন, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
এদিকে খামারিদের এই চরম বিপর্যয়ের সময়ে ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন বা প্রাণিসম্পদ চিকিৎসক পদটি খালি পড়ে আছে। গত বছরের নভেম্বরের ১২ তারিখ বদলিজনিত কারণে শূন্য হওয়া পদটি পূরণ না হওয়ায় খামারিরা তাঁদের এই চরম বিপদে যথাযথ সহায়তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন লিটন জানান, বাংলাদেশে ব্রয়লার এবং লেয়ার মুরগিতে যখন মহাবির্যয়, তখন সোনালি মুরগি আশার আলো দেখাচ্ছিল খামারিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুতে মহামারি আকারে বার্ড ফ্লু, রানিক্ষেত ও গাম্বুরি রোগ দেখা দিয়ে ভৈরব ও কুলিয়ারচরের চার থেকে পাঁচশর মতো খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে খামারিরা লাখ লাখ টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
অপরদিকে পোলট্রি ডিলাররা খামারিদের বাচ্চা, খাদ্য ও ওষুধের মারফত কোটি কোটি টাকা বাকি দিয়েছেন। এখন ওইসব খামারি তাঁদের খামার বন্ধ করে দিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ডিলাররা বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে খালি চেক দিয়ে এসব উপকরণ বাকি এনে খামারিদের দিয়েছিলেন। এখন খামারিরা পালিয়ে গেলেও তাঁদের পালানোর সুযোগ না থাকায় তাঁরা চরম বিপাকে পড়েছেন। ডিলারদের মাঝে অনেকে চেক জালিয়াতির মামলায় এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন। কেউ বা জেলের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
অবিলম্বে এখানকার পোলট্রি ডিলার ও খামারিদের পাশে দাঁড়াতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ব্যবসায়ী নেতা মো. দেলোয়ার হোসেন লিটন। পাশাপাশি পোলট্রিশিল্পকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতেও সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
পোলট্রিশিল্পে ধস নেমেছে উল্লেখ করে ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খান জানান, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খামারিরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তাঁদের অভিযোগ, চিকিৎসকের অভাবে সঠিক রোগ নির্ণয় করতে না পারায় রোগ বেড়েই যাচ্ছে, রোগের সমাধান হচ্ছে না।
বদলিজনিত কারণে গত বছরের ১২ নভেম্বর থেকে ভৈরবে ভেটেরিনারি সার্জন নেই স্বীকার করে এই কর্মকর্তা জানান, বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ভেটেরিনারি সার্জন পাওয়া যায়নি। তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘ভেটেরিনারি সার্জন পেলেই আমরা সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাসেবা দিতে পারব।’
খামারিদের বর্তমান অবস্থা খুবই করুণ উল্লেখ করে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখন খামারিদের সঙ্গে সান্ত্বনামূলক ব্যবহার করে যাচ্ছি।’