ষড়যন্ত্র করে যে অপরাধ সংগঠিত করেছে, তা অত্যন্ত ভয়ংকর ও জঘন্য
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ষড়যন্ত্র করে দুটি বোমা পোঁতার মধ্য দিয়ে যে অপরাধ তারা সংগঠিত করেছে, তা অত্যন্ত ভয়ংকর ও জঘন্য। এ অবস্থায় কয়েকজন কয়েদির (দণ্ডিত আসামি) দীর্ঘ হাজতবাসে তাদের দণ্ড লঘু করার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।’
আজ সোমবার সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহালের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের স্বাক্ষরের পর আজ সোমবার ৮৬ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়।
রায়ে বলা হয়, ‘আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামিরা দেশের প্রচলিত আইন মান্য করতে নারাজ। তারা জঙ্গি তৎপরতার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে চায়। কিন্তু তাদের এ ধরনের চিন্তা দেশের প্রচলিত আইন কখনো সমর্থন করে না। কারণ, তারা সকলেই জন্মগতভাবে এ দেশের নাগরিক। ষড়যন্ত্র করে
দুটি বোমা পোঁতার মধ্য দিয়ে যে অপরাধ তারা সংগঠিত করেছে, তা অত্যন্ত ভয়ংকর ও জঘন্য। এ অবস্থায় কয়েকজন কয়েদির (দণ্ডিত আসামি) দীর্ঘ হাজতবাসে তাদের দণ্ড লঘু করার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।’
রায়ে বলা হয়, আসামিরা তাঁদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন যে একটি নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীসহ তাঁর সফরসঙ্গীদের হত্যা করবেন মর্মে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিস্ফোরকদ্রব্যের সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে দুটি বোমা তৈরি করে ঘটনাস্থালে স্থাপন করেছিলেন তাঁরা। ষড়যন্ত্র অনুযায়ী কাজ সম্পাদনের জন্য আসামিরা বড় ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন দুটি বোমা তৈরি ও তা মাটির নিচে পুঁতে রাখার মধ্য দিয়ে, যাতে ধ্বংসাত্মক ঘটনা সংঘটিত হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, এ ধরনের সংঘটিত অপরাধকে শুধু চেষ্টার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হলে তা অযৌক্তিক বলে বিবেচিত হবে। কারণ, মূল উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আসামিরা তাঁদের লক্ষ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, যে ব্যক্তি অপরাধ সংগঠনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে এবং পরবর্তী সময়ে ওই ষড়যন্ত্র অনুযায়ী কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেই ব্যক্তি প্রমাণসাপেক্ষ উভয় অপরাধের জন্য দায়ী থাকে।
রায়ে বলা হয়, ‘সাক্ষীদের সাক্ষ্য, জব্দ করা আলামতের প্রমাণাদি, আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, উচ্চ আদালতের নজির ও সার্বিক পর্যালোচনায় আমরা মনে করি যে ট্রাইব্যুনালের কর্তৃক প্রদত্ত রায়ের মাধ্যমে আসামিদের (আসামি সারোয়ার হোসেন ছাড়া) বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যান্য দণ্ড প্রদানে কোনো আইনগত ভুল করেননি। কাজেই ডেথ রেফারেন্স অনুমোদিত হলো। আসামিদের দায়ের করা জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিল খারিজ করা হলো।
হাইকোর্টের রায়ে যেসব আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে তারা হলো- ওয়াশিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন, মো. রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম, মো. ইউসুফ ওরফে আবু মুসা হারুন, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বক্কর, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই ও মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর।
এ ছাড়া মেহেদি হাসান ওরফে গাজী খান ওরফে আবদুল ওয়াদুদকে যাবজ্জীবন এবং আনিসুল ওরফে আনিস ও মো. মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমানকে দেওয়া ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। তবে, এরই মধ্যে কারাবন্দি এই দুজনের সাজাভোগ করা হয়ে গেলে তাদের কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বলা হয়েছে। আর, নিম্ন আদালতে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সরোয়ার হোসেন মিয়াকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেছিলেন। ভাষার মাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলায় এ রায় দিয়েছিলেন আদালত।
শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এ মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক মমতাজ বেগম ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট ১০ জঙ্গির সর্বোচ্চ শাস্তির রায় দেন। পরে আদালত গুলি করে প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন। এ ছাড়াও চার আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেন।
মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা হলো ওয়াশিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন, মো. রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম, মো. ইউসুফ ওরফে আবু মুসা হারুন, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বক্কর, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই ও মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর। পাশাপাশি আসামি মেহেদি হাসান ওরফে আবদুল ওয়াদুদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আসামি আনিসুল ওরফে আনিস, মো. মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান এবং সরোয়ার হোসেন মিয়াকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অনাদায়ে আরও এক বছরের দণ্ড দেওয়া হয়। পরে এ মামলার রায়সহ সব নথি ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট হাইকোর্টে পাঠানো হয়।
২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়। শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশের একটি চায়ের দোকানের পেছনে এ বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় তৎকালীন কোটালীপাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নূর হোসেন একটি মামলা দায়ের করেন।