শিশুটি কবরে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘আব্বা, আপেল কিনে দেবা না?’
রাজধানীর চকবাজারের চুরিহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে নিহত গোলাম মোস্তফার কবরে গিয়ে প্রায়ই দাঁড়ায় তাঁর ছোট ছেলে জিসান (৫)। কবরে দাঁড়িয়ে জিসান দাদির কাছে প্রশ্ন করে, ‘আব্বা ডাক শুনতেছে না কেন? আব্বা আপেল কিনে দেবে না? আব্বাকে এই জায়গায় রাখছ কেন?’
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর চুরিহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দাঁড়িয়ে গোলাম মোস্তফার স্ত্রী জেসমিন আক্তার কাঁদতে কাঁদতে এনটিভি অনলাইনকে এসব কথা বলছিলেন।
শুধু জেসমিন আক্তার নন, সেদিনের ভয়াভর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের পরিবারের সদস্যরা আজ গিয়েছিলেন ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একেকজনের একেক রকম আকুতিভরা বিলাপ। ছেলে গিয়েছিল তার মায়ের স্মরণে। স্ত্রী গিয়েছিল স্বামীর স্মরণে। ভাইয়ের আকুতি ছিল ভাইয়ের প্রতি।
সকাল থেকেই চুরিহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে সেদিনের আগ্নিকাণ্ডে পুড়ে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জড়ো হয়েছিলেন। বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে মানববন্ধনও করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। এ ছাড়া চুরিহাট্টা শাহি জামে মসজিদে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে হাফেজরা এসে নিহতদের স্মরণে পড়ছেন কোরআন শরিফ।
হাতে স্বামীর ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন স্ত্রী জেসমিন আক্তার। বিলাপ করতে করতে জেসমিন আক্তার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “বাড়ির পাশেই আমার স্বামীর কবর। আমার ছোট ছেলে জিসান সব সময় কবরে যায়। কবরে গিয়ে দাদির কাছে জানতে চায়, ‘আব্বা কথা কয় না কেন? ডাক শুনতেছে না কেন আব্বা? আব্বাকে এই জায়গায় রাখছ কেন? আব্বা আপেল কিনে দেবে না?’ দাদির সঙ্গে সঙ্গে সব সময় থাকে জিসান। কবরে গিয়ে আব্বা আব্বা বলে ডাকে। এসব শুনে দাদি কান্না করে। তাই দেখে জিসানও কান্না করে।”
গোলাম মোস্তফা ঢাকায় রিকশা চালাতেন। তিন ছেলেসহ তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তার থাকতেন রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনি নিহত হওয়ার তিন মাস পর জেসমিন আক্তার সংসার চালাতে না পেরে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে বাড়িতে বাড়িতে রান্নার কাজ শুরু করেন। তবে তিনি ঢাকাতে এলেও তিন ছেলেকে রেখে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। এই প্রতিবেদককে এসব বলছিলেন জেসমিন আক্তার।
জেসমিন আক্তার থাকেন পুরান ঢাকার নাজিমুউদ্দিন রোডে। তিনটি বাড়িতে রান্নার কাজ করেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘মন খারাপ হলেই এই পোড়া ভবনের (ওয়াহেদ ম্যানশন) সামনে চলে আসি। এসে কান্না করলেও মন হালকা হয়। কিন্তু চিন্তা হয় তিন ছেলেকে নিয়ে। ওদের ঠিকমতো টাকা দিতে পারি না। খেতে দিতে পারি না। বাড়িতে না থাকার ফলে ওদের ইচ্ছে হলে স্কুলে যায়, না হলে না যায়। তিনটি বাড়িতে কাজ করে পাই ছয় হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকায় হচ্ছে না। তিন ছেলের স্কুলেই টাকা দিতে হয়। বড় ছেলে জিহাদ (১২) ক্লাস ফোরে পড়ে। মেঝ ছেলে জীবন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আর জিসানকে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করেছি।’
ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশেই থাকতেন আয়েশা খাতুন। ঘটনার সময় তিনি গিয়েছিলেন একটি ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে। ওষুধ কিনতে গিয়েই তিনি ওই ফার্মেসির ভেতরে আটকা পড়ে আগুনের ঘটনায় নিহত হন। আজ দুপুরের দিকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন আয়েশার ছেলে মো. তামিম (১৫)। তামিম ওই ভবনের আশপাশেই খেলা করে সব সময়। নামাজও পড়ে পোড়া ভবনের পাশের মসজিদে। পুরান ঢাকাতেই জন্ম তার।
বুকে কালো ব্যাজ লাগানো ছিল তামিমের। মায়ের স্মরণে তামিম বলে, ‘মা যখন ওষুধ কিনতে গিয়েছিল। তখন আমিও নিচে নেমেছিলাম। কিন্তু আমি বাড়ির নিচের দোকানে এক কাকার সঙ্গে। তারপর হঠাৎ আগুন ধরে যায়। মাকে আর জীবিত দেখতে পাইনি। মাকে চেনাও যাচ্ছিল না। আমার মায়ের এক কানে একটি দুল ছিল। ওই দুল দেখেই আমরা মাকে শনাক্ত করতে পারি। এখানেই আমার জন্ম। এখানেই খেলা করি সব সময়। মায়ের জন্য কষ্ট হয় এই স্থান দিয়ে গেলে। কিন্তু কোথায় যাব?’ বলতে বলতেই কেঁদে উঠে তামিম।
কাজী এনামুল হক ছিলেন ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী। ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের রাতে তিনি পুরান ঢাকার মদিনা ডেন্টাল ক্লিনিকে গিয়েছিলেন চিকিৎসকের কাছে। মদিনা ক্লিনিককটা ছিল ওয়াহেদ ম্যানশনের কাছাকাছি স্থানে। এনামুলের স্মরণে আজ সেখানে গিয়েছিলেন তাঁর ছোট ভাই রশিদ কবির।
রশিদ কবির বলেন, 'এই রাস্তার ওপরেই আমার ভাই পুড়ে মারা গেছেন। এই রাস্তায় আমার ভাই ছটফট করতে করতে মারা গেছেন। রাত থেকে খুব খারাপ লাগছিল তাই এখানে এসেছি। ' বলতে বলতে চোখ ভিজে উঠে রশিদের।