‘লিবিয়ায় ২০ জনের বেশি মাফিয়া গুলি করেছিল বাংলাদেশিদের’
একটি একতলা ভবন। ভবনে দুটি কক্ষ। একটি কক্ষ ছোট, যেখানে ‘মাফিয়ারা’ থাকত। আর একটি বড় কক্ষ। ওই কক্ষে প্রতারণার শিকার হওয়া বিদেশগামী ভুক্তভোগীদের নির্যাতন করে অর্থ আদায় করা হতো। ওই ভবনের চারপাশ থেকে ২০ জনের বেশি মাফিয়া একই সঙ্গে গোলাগুলি শুরু করে। এতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ১২ জন আহত হন। ঘটনাটি গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে ঘটেছিল।
লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানবপাচাকারী মাফিয়াদের হামলা থেকে বেঁচে ফেরা আহত তরিকুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে এভাবেই ওই ঘটনার বর্ণনা দেন।
তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘একতলা ভবনের অন্তত ১৫ ফুট দূরত্বে বাউন্ডারি দেওয়া। বাউন্ডারি দেওয়া দেয়ালের ওপর তারের কাঁটা দেওয়া ছিল। বাইরে থেকে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না। মাফিয়ারা বাউন্ডারির ভেতরে ঢুকে কেউ ছাদে উঠে, কেউ ঘরের জানালার পাশ থেকে, কেউ বা আবার গাড়ির ভেতর থেকে একই সঙ্গে গুলি করা শুরু করে। ওই সময় ২০ থেকে ২৫ জন মাফিয়া গোলাগুলি করে। ধুপধাপ করে মানুষ পড়ে যেতে থাকে। আমি লাশের পাশে ভয়ে ভয়ে শুয়ে ছিলাম।’
তরিকুল ইসলাম আরো বলেন, ‘ঘটনার চার দিন আগে আমাদের মোট ২৯ বাংলাদেশিকে ওই ভবনে নিয়ে যায় মাফিয়ারা। গিয়ে দেখি আরো ৯ জন বাঙালি আছেন সেখানে। একজন নাইজেরিয়ান মরে পড়ে ছিল সে সময়। যারা আমাদের ওই ভবনে নিয়ে যায়, তারা প্রথমে রাস্তা থেকে হামলা চালায়। হামলা করে একটি গাড়ি থেকে আমাদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ওখানে নিয়েই আমাদের সবার কাছে ১২ হাজার ডলার করে চায়। তিনবেলা মারধর করত তারা। মারতে মারতে আমাকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলেছিল। যখন ওরা গুলি করে, তখন আমার আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল না। আমি বসে ছিলাম সে সময়। হঠাৎ দেখি আমার পাশের একজন গুলি খেয়ে ধপাস করে নিচে পড়ে গেল। রক্তে পুরো রুম ভেসে যাওয়ার অবস্থা। লোকটি তখন মারা যায়। আমি ভয়ে ভয়ে ওই লাশের পাশে শুয়ে ছিলাম।’
হঠাৎ তারা গুলি কেন করল—এমন প্রশ্নে তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভবনের ওই বড় কক্ষে আমরা মোটামুটি ২০০ জনের মতো ছিলাম। এদের ভেতরে নাইজেরিয়ান আর সুদানের লোক ছিল বেশি। গুলি করার দুই ঘণ্টা আগে তিনজন মাফিয়া আসে আমাদের মারতে। লোহার পাইপ দিয়ে আমাদের পেটানো শুরু করে। সে সময় নাইজেরিয়ান আর সুদানিরা এক মাফিয়াকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এরপরই একের পর এক মাফিয়ারা আসতে থাকে সেখানে। তারপর তারা গুলি করতে শুরু করে। গুলি করার সময় তখনই অন্তত ১৫ জন মারা যায়। পরে ওরা আবার ঘরে ঢুকে ককটেল মারে। সে সময় আরো কয়েকজন মারা যায়। মাফিয়াকে মারল নাইজেরিয়ানরা আর ওরা ভাবল বাংলাদেশিরা মেরেছে। সে জন্য দেখে দেখে বাঙালিদের গুলি করা হয়।’
তরিকুল ইসলাম আরো বলেন, ‘গুলি করে মাফিয়ারা চলে যায়। পরে কারা যেন সেনাবাহিনীর পোশাক পরে ভেতরে ঢোকে। ঢুকে পা দিয়ে আমাদের নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখে, কে বেঁচে আছে। পরে আমাদের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে রাখেননি চিকিৎসকরা। পরে আবার আরেকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে মরুভূমির একটি ময়লার স্তূপে নিয়ে আমাদের মোট ১১ জনকে ফেলে রেখে আসে কয়েকজন। সেখান থেকে আমরা একজনের ঘরে আশ্রয় নিই। তারপর আমরা আমাদের দূতাবাসে যোগাযোগ করি। পরে আমাদের একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
ওই পর্যন্ত কীভাবে গেলেন—এমন প্রশ্নে তরিকুল বলেন, ‘প্রথমে আমাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে বলে দালালরা। পরে ফ্লাইট না হওয়ায় ঢাকায় ফিরে আসি। তারপর গ্রামের বাড়ি মাগুরায় চলে যাই। এক সপ্তাহ পর আবার ঢাকায় আসি। ঢাকা থেকে আমাকে পাঁচজন নারীর সঙ্গে নেপাল পাঠাল। সঙ্গে দালালও ছিল। সেখান থেকে দুবাই, তিন দিন পর নেওয়া হয় মিসরে। এর একদিন পর নেওয়া হয় লিবিয়ার ব্যাঙ্গাজি বিমানবন্দরে। সেখান থেকে সনাতন নামের এক দাদার ক্যাম্পে রাখা হয় আমাদের। খাবার দিত না ওরা। পরে পৌঁছানোমাত্রই চুক্তির সাড়ে চার লাখ টাকা চান হাজি কামাল নামের এক দালাল। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ায়। টাকা দেওয়ার পর খেতে দেন। এরপর তিনি আট মাস পর আমাকে আরেকজনের কাছে দিয়ে দেন। যার কাছে দিয়ে দেন, তিনি আমাকে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেন। তারপর যেতে যেতে গাড়ি থেকে আমাদের হামলা করে নিয়ে যায়। এই পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গতকাল আমি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলাম।’
লিবিয়ার ওই হামলায় গুরুতর আহত ১২ বাংলাদেশির মধ্যে ৯ জনকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। যাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তাঁরা হলেন—ফিরোজ বেপারী, জানু মিয়া, ওমর শেখ, সজল মিয়া, তরিকুল ইসলাম, বকুল হোসেন, মোহাম্মদ আলী, সোহাগ আহমেদ ও সাইদুল ইসলাম। যাঁদের আনা সম্ভব হয়নি, তাঁরা হলেন—বাপ্পীদত্ত, সম্রাট খালাসী ও সাজিদ।
পঙ্গু হয়ে বেঁচে ফেরা ফিরোজ বেপারী বলেন, ‘এ হামলায় আমি চিরতরে পঙ্গু হয়ে গিয়েছি। সারাজীবন আমাকে পঙ্গুত্ব নিয়েই বাঁচতে হবে। মারতে মারতে আমার হাত-পা সব ভেঙে ফেলেছে ওরা। নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলের জন্য লিবিয়ায় গিয়েছিলাম। পরিবারের বোঝা হয়ে ফিরে আসলাম। যারা আমাদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করেছে, আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমি বাবার জমি বিক্রি করে বিদেশ গিয়েছিলাম। এখন এই অবস্থা। বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার। সত্যিই আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। এখন মনে হচ্ছে, এ জীবন দিয়ে মানুষের কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না।’