লিবিয়ায় ভৈরবের বাসিন্দা হতাহতের ঘটনায় ৩ জন গ্রেপ্তার
লিবিয়ায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ছয়জন নিহত ও তিনজন আহত হওয়ার ঘটনায় মানবপাচারকারীচক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১৪, ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যরা। গ্রেপ্তারকৃতরা নিহত ছয় যুবককে বিভিন্ন কৌশলে কয়েকবার হাত বদলের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাচার করে বলে জানিয়েছে র্যাব।
গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন হেলাল উদ্দিন হেলু, শহিদ মিয়া ও খবির উদ্দিন। এদের বাড়ি ভৈরবের তাতাঁরকান্দি, লক্ষ্মীপুর ও শম্ভুপুর গ্রামে।
এ বিষয়ে আজ বুধবার দুপুরে ভৈরব র্যাব ক্যাম্পে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১৪ ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইফতেখার উদ্দিন এসব কথা জানান।
র্যাব জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল মঙ্গলবার ভৈরব রাতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এদেরকে গ্রেপ্তার করেন। পরে জিজ্ঞাসাবাদে লিবিয়ায় নিহতদের পাচারে তাদের সক্রিয় থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব দাবি করে।
সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইফতেখার উদ্দিন জানান, গত ২৮ মে লিবিয়ায় মিজদা শহরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ১১ বাংলাদেশি মারাত্মকভাবে আহত হয়। ঘটনার পর থেকে দূতাবাসের পক্ষ থেকে আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঘটনার কারণ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। ওই ঘটনায় কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের ছয়জন নিহত ও তিনজন আহত হয়। নিহতরা হচ্ছে মোহাম্মদ আলী (২৫), মাহবুবুর রহমান (২১), রাজন চন্দ্র দাস (২৭), সাকিব মিয়া (১৮), সাদ্দাম হোসেন আকাশ (২৫) ও শাকিল (২০)। আহতরা হলো সৌরভ আহম্মেদ সোহাগ (২২), মো. সজল মিয়া (২০) ও মো. জানু মিয়া (২৭)।
র্যাব কর্মকর্তা আরো জানান, ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া দালালদের মাধ্যমে তারা অবৈধভাবে লিবিয়ায় যান। পরবর্তীতে তারা দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পরে হামলার শিকার হয়। এই বর্বরোচিত ঘটনায় মূল উদ্ঘাটন করতে গিয়ে দেখা যায় যে, অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার জন্য দালালচক্র ইউরোপে উন্নত জীবনের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিনিয়ত অসহায় বাংলাদেশীদের অবৈধভাবে নৌ-পথে এবং দুর্গম মরুপথ দিয়ে পাঠিয়ে আসছে। এই অবৈধ অভিবাসীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জিম্মি করে প্রতিনিয়ত মুক্তিপণ দাবি এবং শারীরিক নির্যাতন করে। উল্লেখিত প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মিডিয়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আত্মীয়স্বজনরা এরই মধ্যে ভৈরব থানায় মানবপাচার দমন ও প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছেন।
এই ঘটনায় র্যাব-১৪ প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ছায়া তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভৈরবের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে দালালচক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা হলো-শহরের তাঁতারকান্দি গ্রামের আবদুর রশিদ মিয়ার ছেলে মো. খবির উদ্দিন (৪২), লক্ষ্মীপুর গ্রামের মৃত সুরুজ মিয়ার ছেলে শহিদ মিয়া (৬১) ও শম্ভুপুর গ্রামের মৃত আব্দুল আহাদ মিয়ার ছেলে হেলাল উদ্দিন হেলু (৪৫)।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, নিহত মোহাম্মদ আলী ও মাহবুব এবং আহত জানু মিয়া কুখ্যাত মানবপাচারকারী মো. হেলাল উদ্দিন হেলু ও মো. খবির উদ্দিনের মাধ্যমে অবৈধভাবে প্রতিজন তিন লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়া যান। নিহত সাকিব, আকাশ ও শাকিল এবং আহত সোহাগ কুখ্যাত দালাল তানজিল (বর্তমানে লিবিয়ায় অবস্থিত), নাজমুল (তানজিলের ভাতিজা), জুবুর আলী ও মিন্টু মিয়ার মাধ্যমে চার লাখ টাকা করে দিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়া যান। নিহত রাজন চন্দ্র দাস কুখ্যাত দালাল জাফর ও তাঁর স্ত্রী রূপা আক্তার, মানিক, হিরা ও শহিদ মিয়ার মাধ্যমে চার লাখ টাকা দিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়া যান।
মানিক ও জাফর লিবিয়ায় থেকে মানবপাচারকারবারীর নেতৃত্ব দেন এবং বাংলাদেশে তাঁদের হয়ে লোক সংগ্রহ করা, আর্থিক লেনদেনসহ যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতেন শহিদ মিয়া, হিরা, রূপা আক্তার ও হযরত আলী। বাংলাদেশে তানজিলের মানবপাচার কারবার পরিচালনা করতেন তার ভাতিজা নাজমুল, জুবুর আলী ও মিন্টু মিয়া।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আরো জানান, তারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশিচক্রের সঙ্গে যোগসাজসে অবৈধভাবে এলাকার যুবকদের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। এই সিন্ডিকেটটি চারটি ধাপে কাজগুলো করতো বলো জানায়। বিদেশে যেতে ইচ্ছুক নির্বাচন, বাংলাদেশ থেকে ভারতের কলকাতায় পাঠানো, কলকাতা থেকে লিবিয়ায় পাঠানো এবং লিবিয়া থেকে ইউরোপে পাঠানো।
বিদেশে যেতে ইচ্ছুক নির্বাচনকালে এই চক্রের দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে থাকে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। এই বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট ক্রয় ইত্যাদি কাজ এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
পরবর্তীতে তাদেরকে এককালীন বা ধাপে ধাপে কিস্তি নির্ধারণ করে ইউরোপের পথে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী ধাপ নির্বাচন করে থাকে। ইউরোপ গমনের ক্ষেত্রে তারা ছয়-সাত লাখ টাকার বেশি অর্থ নিয়ে থাকে। এর মধ্যে তিন-চার লাখ টাকা লিবিয়ায় যাওয়ার আগে এবং বাকি দুই থেকে তিন লাখ টাকা লিবিয়ায় যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নেয়।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।