র্যাবের অর্জন কিছুটা হলেও ম্লান হবে
সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে না পারলে র্যাবের অর্জন কিছুটা হলেও ম্লান হবে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। বিশেষায়িত এই বাহিনী ব্যর্থতার দায়ভার বহন করুক, এটা কারো কাম্য নয় বলেও মন্তব্য করেন আদালত।
আজ বৃহস্পতিবার এ মামলার তদন্ত সংক্রান্ত এক রুলের আদেশে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
লিখিত পর্যবেক্ষণে আদালত, সাংবাদিক দম্পতি সাগর–রুনির নৃশংস হত্যাকাণ্ড সারা দেশে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। নিহতদের পরিবার, সাংবাদিক সমাজসহ দেশের সবস্তরের মানুষের দৃঢ় প্রত্যাশা ছিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সমাপ্ত করে হত্যার মোটিভ, প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত, গ্রেপ্তার ও বিচারের সম্মুখীন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। কিন্তু রুঢ় সত্য ও বাস্তবতা হলো এই যে, দীর্ঘ প্রায় সাত বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এ হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম সমাপ্ত এবং প্রকৃত অপরাধীদের মনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেন, আদালতের নির্দেশে মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মামলার কেস ডকেট আদালতে উপস্থিত হয়ে আদালতকে অবহিত করেছে যে, এই মামলায় এ যাবৎকালে মোট আট ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হলেও এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের কারো সম্পৃক্ততা অদ্যবধি পাওয়া যায়নি। গ্রেপ্তারকৃতদের কেউ ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। এফবিআই কর্তৃক চার ব্যক্তির ডিএনএ, যার মধ্যে দুটি মৃত ব্যক্তিদ্বয়ের মনাক্ত হলেও বর্তমান আসামি বা গ্রেপ্তারকৃত অন্য আসামিদের সঙ্গে অপর দুটি ডিএনএ ম্যাচ করেনি। অর্থাৎ অপর দুই ব্যক্তিকে অদ্যবধি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আমেরিকার বিশেষায়িত ল্যাবরেটরিতে ডিএনএর ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য অপরাধীদের ‘অবয়ব’ তৈরির চেষ্টা চলছে।
দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও তদন্তের মাধ্যমে এ মামলার রহস্য উদঘাটিত না হওয়া এবং অপরাধীদের চিহ্নিত, গ্রেপ্তার এবং বিচারের সম্মুখীন না করতে পারা– নিঃসন্দেহে দুঃখ ও হতাশার বিষয়।
আদালত পর্যবেক্ষণে আরো বলেন, প্রযুক্তির নির্ভর অভিজাত ও চৌকস বাহিনী হিসেবে র্যাব দেশে জঙ্গি, সন্ত্রাস, মাদক, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, ভেজাল প্রতিরোধসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অনন্য সফলতা পেলেও ম্লান হবে, যদি এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও দোষীদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করতে না পারে।
আদালত প্রত্যাশা করছে যে, র্যাব অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে হত্যার রহস্য উন্মোচন ও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করতে সক্ষম হবে। বিশেষায়িত এই বাহিনী ব্যর্থতার দায়ভার বহন করুক –এটা কারোই কাম্য নয়।
একইসঙ্গে আদালত এ হত্যা মামলায় তদন্তের অগ্রগতি আগামী ৪ মার্চের মধ্যে জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। এই মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক মো. তানভীর রহমানের সম্পৃক্ততার বিষয়েও প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আদালত তানভীর রহমানকে নিম্ন আদালতে স্বশরীরে হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তবে আইনজীবীর মাধ্যমে তাঁকে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। আদালত আগামী ৪ মার্চ পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সরওয়ার হোসেন বাপ্পী। তানভীরের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
এর আগে, এ হত্যা মামলা বাতিল চেয়ে সন্দেহভাজন আসামি মো. তানভীর রহমানের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করেন এবং গত ৬ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার শফিকুল আলম হাইকোর্টে হাজির হলে মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানান। এরপর আদালত মামলাটির রায়ের জন্য আজ ১৪ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করেছিলেন।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। পরের দিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় রুনির ভাই বাদী হয়ে আদালতে একটি মামলা করেন। প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার এক উপপরিদর্শক (এসআই)। পরে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সাত বছরেও মামলার তদন্তে অগ্রগতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এ মামলায় রুনির বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট আসামি আটজন। অন্য আসামিরা হলো−বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ, পলাশ রুদ্র পাল ও আবু সাঈদ। আসামিদের প্রত্যেককে একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হলেও তাদের কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি।
এদিকে আজ ১৪ নভেম্বর এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাসের আদালতে দাখিলের দিন নির্ধারণ সত্ত্বেও ৬৯ বারের মতো প্রতিবেদন দাখিল পেছানো হয়।