রায়ের আগে পরে মজনু যা ঘটান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রী ধর্ষণ মামলার একমাত্র আসামি মজনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
বিকেল ৩টার পর রায়ে আদালত বলেন, ‘আসামি মজনু, শেওড়া বটতলা এলাকায় ভাসমান, খিলক্ষেত- ঢাকার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত-২০০৩)-এর ৯ (১) ধারা মতে, রাষ্ট্রপক্ষের আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের এ ধারায় দোষী সাব্যস্ত পূর্বক যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরো ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো।’
“এ ছাড়া আসামি মজনুর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৯৪ ও ৪১১ ধারার ছিনতাই ও চুরির অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় উক্ত ধারার অভিযোগ হতে তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো। রায়ে আদালত বলেন, ‘ডকে উপস্থিত হাজতি আসামির বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হোক।’”
এ রায়কে কেন্দ্র করে আজ সকাল থেকে আদালতপ্রাঙ্গণে সাংবাদিক, আইনজীবী ও উৎসুক জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। পরে দুপুর আড়াইটার দিকে মজনুকে আদালতের এজলাসে হাজির করা হয়। এজলাসে ওঠানোর আগে মজনুকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের গারদ থানার নিচে থেকে আদালতের ছয় তলায় হেঁটে উঠানো হয়। এ সময় মজনু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এজলাসে ভেতরে উঠানোর পর মজনু অস্বাভাবিক আচরণ করেন। আদালতে হাজিরের পর মজনু পুলিশ-আইনজীবী ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘আমি এতিম অসহায়। আমার পক্ষে কেউ নাই। আমারে ছাইড়া দেন, আমি বাড়ি চলে যাব। আমি জখম করিনি। আমি ধর্ষণ করিনি, ধর্ষণ করেছে চারজন লোক। আমি তাদের চিনি। আমাকে পিটাইয়া হাতের আঙুল ভেঙে ফেলছে। পুলিশ আমাকে মাইরা টিপসই নিয়ে গেছে। আমারে এক বছর আটকাই রাখছে। জেলে মশার কামড় খাইয়া থাকতে পারছি না। আমারে শুধু কচুর ডাল খাওয়ায়। আমারে ছাইড়া দেন।’
কান্নারত অবস্থায় মজনু বলতে থাকেন, ‘একজন মহিলা আমাকে ফাঁসাই দিছে। ধর্ষণ করেছে চারজন লোক। তাদের গ্রেপ্তার না করে আমাকে ধরে নিয়ে আসছে। আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে, আমি রাষ্ট্রপতির কাছে বিচার দিমু। আমারে মারলে আল্লাহ তার বিচার করবে। পুলিশ ঘুষ খাইয়া আমাকে ফাঁসাইছে। আমারে ছাইড়া দেন, না হয় আমি এহান থেকে লাফ দিয়া মইরা যামু।’
এ সময় এজলাসের সামনে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা আসামি মজনুকে ধমক দিয়ে কথা বলা বন্ধ করতে বললে মজনু চিৎকার দিয়ে ওঠেন।
এজলাসে থাকা মজনু একাধারে বলতে থাকেন, ‘আমাকে কেউ থামাতে পারবে না। আমি আজকে বলে যাব। অনেক সহ্য করেছি। কেউ আইজকা আমারে থামাইতে পারবে না।’
পুলিশ মজুনকে আবারও ধমক দিলে তিনি আরো ক্ষেপে যান। এ সময় মজনু বলতে থাকেন, ‘পুলিশ টাকা খাইয়া আমারে ফাঁসাইয়া দিছে। কাউকে বিশ্বাস করি না। সব চোর। আমারে ছাইড়্যা দে। আইজকা একশজনেও থামাইতে পারবে না। আমি সব বইলা দিমু। ফেনীর জয়নাল হাজারি আমার মামা। আমার মা কান্না করতেছে। তার কাছে টাকা নাই। আমারে মায়ের কাছে যেতে দিন।’
একাধারে মজনু বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে প্রথম যখন ঢাকায় আসি তখন আমার স্ত্রীকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে। আমি কারো কাছে বিচার পাইনি।’ এ সময় পুলিশ থামাতে চাইলে দায়িত্বরত উপপরিদর্শক (এসআই) নৃপেনকে পেছন থেকে গলা চেপে ধরে কিল-ঘুষি মারেন মজনু। তখন অন্য পুলিশ সদস্যরা এসে এসআই নৃপেনকে সরিয়ে নেন। আদালতে হৈচৈ পড়ে যায়। আক্রান্ত এসআই নৃপেন আসামি মজনুকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেন। মজনু তাঁকে বলেন, ‘আপনি ভালো মানুষ। আপনি আমার কথা শুনছেন।’
তখনো পুলিশ, বিচারক ও আইনজীবীদের গালিগালাজ করতে থাকেন মজনু। বিচারক তখনো বিচারকক্ষে আসেননি। এ সময় মজনুর চিৎকার চেচামেচির কারণে বিচারক খাসকামরা থেকে অফিস স্টাফের মাধ্যমে নির্দেশ দেন, নির্ধারিত দুজন আইনজীবী ছাড়া অপর আইনজীবী ও সব সাংবাদিককে বিচার কক্ষের বাইরে অবস্থান করতে বলেন।
এরপর একে একে সবাইকে বের করে দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়। মাত্র দুই মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন বিচারক। রায়ে মজনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের দণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ের সময় মজনু স্বাভাবিক ছিলেন। কোনো কথা বলেননি বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ অরেঞ্জ। এরপর এজলাস থেকে মজনুকে দুই পাশে ধরে বের করে নিয়ে আসেন পুলিশ সদস্যরা। মজনু স্বাভাবিকভাবে ছয়তলা থেকে হেঁটে নামেন। কিন্তু নিচে গিয়ে মজনু পুলিশের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাঁকে টেনেহিচড়ে নিয়ে যাইতে চাইলে তিনি এসআই নৃপেনের হাতে কামড় দেন। তখন পুলিশ সদস্যরা মজনুর মুখ চেপে ধরেন। কামড়ের ফলে এসআই নৃপেনের হাতে সামান্য জখম হয়। তাঁর হাতে কামড়ের চিহ্ন আছে।
কামড়ের পর একপর্যায়ে মজনু ধস্তাধস্তি করতে থাকেন। পরে টেনেহিচড়ে তাঁকে গারদখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যার আগেই মজনুকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে এসআই নৃপেন সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, মজনু তাঁকে কামড় দেননি। তিনি কামড় দিয়ে হাতকড়া ভাঙতে চেয়েছিলেন। তখন পুলিশ নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মজনুকে মারধর করে।
ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন আদালত। মাত্র ১৩ কার্যদিবসে মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে।
এর আগে গত ১৬ মার্চ মজনুকে একমাত্র আসামি করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক আবু সিদ্দিক।
সে অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, গত ৪ জানুয়ারি ওই ছাত্রী বান্ধবীর দাওয়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষণিকা বাসে করে তাঁর বান্ধবীর বাসা শেওড়ার উদ্দেশে রওনা হন। সেদিন সন্ধ্যা ৭টায় ছাত্রী শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে না নেমে কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নেমে যান। সে সময় ছাত্রী বুঝতে পারেন, তিনি ভুল করে নেমে পড়েছেন। ভুল বুঝতে পেরে তিনি ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মজনু ভবঘুরে প্রকৃতির লোক। ঢাকা শহরে তাঁর কোনো স্থায়ী বাসা নেই। ঘটনার দিন মজনু বিকেল ৫টায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যান। ওষুধ নিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু পূর্বদিকে যাওয়ার রাস্তার ফুটপাতের পাশে ইটের তৈরি বেঞ্চে বসে থাকেন। সন্ধ্যা ৭টায় ছাত্রী ওই ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছিলেন। মজনু পেছন দিক থেকে হঠাৎ তাঁকে পাশের ঝোপের ভেতরে ফেলে দেন। তখন ছাত্রী চিৎকার করতে থাকলে মজনু গলা চেপে ধরেন এবং মুখে, বুকে ও পেটে কিল ঘুষি মারেন।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়েছে, আসামি মজনু ছাত্রীর গলা চেপে ধরায় তিনি নিস্তেজ হয়ে যান। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তখন মজনু তাঁকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পরে মজনু ছাত্রীর ব্যাগ থেকে একটি প্যান্ট বের করে তাঁকে পরিয়ে দেন। ছাত্রী জ্ঞান ফেরার পরে দেখেন তাঁর পরনে যে প্যান্ট ছিল সেটা আর নেই। ছাত্রী তখন চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে মজনু টাকা, মোবাইল ফোন ও ব্যাগ ছিনতাইয়ের জন্য গলা চেপে ধরেন এবং কিল-ঘুষি মারেন। একপর্যায়ে মজনু ছাত্রীর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা, মোবাইল ফোন ও ব্যাগ ছিনিয়ে নেন। এরপর ছাত্রী দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে একটি রিকশায় ওঠেন এবং তাঁর বান্ধবীর বাসায় যান। বান্ধবীকে বিষয়টি জানালে ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, এরপর ধর্ষণের শিকার ছাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামত, ছাত্রীর পরা প্যান্ট, ছাত্রী ও আসামির নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চিফ ডিএনএ অ্যানালিস্টের কাছে পাঠানো হয়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, মজনু ও ছাত্রীর ডিএনএ উপস্থিত আছে। যাতে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয় যে আসামি মজনু ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন।