রাজশাহীতে ঝরে গেছে প্রায় ২০ ভাগ আম
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের শেষ ছোবল ছিল রাজশাহীর ওপর। সেই ছোবলে জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল আমের প্রায় ২০ শতাংশ গাছ থেকে ঝরে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে জেলা প্রশাসক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আমের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা অসম্ভব বলে দাবি করেছেন আম ব্যবসায়ী ও চাষিরা।
এদিকে, রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, ‘আম্পানের মূল কেন্দ্র রাজশাহীতে আঘাত করেনি। তবে রাত ২টা ৫৫ মিনিট থেকে ২টা ৫৮ মিনিট পর্যন্ত এখানে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫৯ কিলোমিটার। এটি অবশ্য ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রায় পড়ে না। বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটারের ওপরে থাকলে তাঁকে ঘূর্ণিঝড় বলে। রাজশাহীতে ঘূর্ণিঝড়ের একধাপ নিচের মাত্রার ঝড় হয়েছে। সেইসঙ্গে বৃষ্টিপাতও হয়েছে। গতকাল ভোর ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৮১ মিলিমিটার।’
তবে আম্পানের প্রভাবে গাছের আম ঝরে পড়ায় চাষিদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। চাষিরা বলছে, এবার এমনিতেই আমের ফলন কম। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দাম পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে তারা। তার ওপর ঝড়ে আম ঝরে পড়ায় ফলনও কমে গেল। এতে তারা লোকসানের মুখে পড়বে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামসুল হক বলেন, ‘রাতেই বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে আমরাই জেলা প্রশাসককে জানিয়েছিলাম যে ২০ শতাংশ আম ঝরে পড়েছে। তবে সকালে আমরা বিভিন্ন বাগান পরিদর্শন করে দেখছি ক্ষতির পরিমাণ আরেকটু কম। শহরে ১০ শতাংশ এবং চারঘাট উপজেলায় এসে ১৫ শতাংশ আম ঝরে পড়ার দৃশ্য দেখছি। বাঘা উপজেলায় বাগান বেশি। সেখানে ক্ষতি আরেকটু বেশি হয়েছে। এতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
যোগাযোগ করা হলে বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামের আম চাষি ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাগানে ঢিলের মতো আম পড়ে আছে। তারা কুড়াচ্ছেন। আচারের জন্য দুই থেকে পাঁচ টাকা কেজি দরে এসব আম বিক্রি করতে হবে। আর ক’টা দিন গেলেই এসব আম পরিপক্ব হয়ে যেত। এখন বাগানের ফলন কমে যাবে। এবার আমে লাভ হবে না।’
চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রামের আমচাষি বীর বাহাদুর বলেন, ‘ঝড়ে আমসহ ভুট্টুা ও তিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। যে আম বিক্রি হতো ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে, সেই আম ঝরে পড়ায় তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০ পয়সা কেজিদরে। আম কেনার লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এমনেই মহামারি করোনায় আমরা আম নিয়ে সংশয়ে রয়েছি। তার ওপর এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবার জীবনে বয়ে এনেছে কষ্টের পাহাড়। আম বাগানে যেতেই মন ভেঙে পড়ছে। এর আগে কখনো ঝড়ে আমের এমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামসুল হক বলেন, ‘আম ঝরে গেলে তো ফলন কমবেই। এখন চাষিরা যদি আমের ভালো দাম না পান, তাহলে হয়তো এবার তারা ক্ষতির মুখে পড়বেন। তাই আমের যেন সঠিক মূল্য পাওয়া যায়, তার জন্য যা যা করা দরকার, আমাদের করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ঝড়ে রাজশাহীর অন্য কোনো ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি। মাঠে পাকা ধান আছে। সেগুলো মাটিতে শুয়ে গেছে। তবে ধান পেকে যাওয়ায় চাষিরা তা এখন কেটে নেবেন। তাই ধানের ক্ষতি হবে না। তবে কিছু ধান ঝরে যেতে পারে। মাঠের সবজির কোনো ক্ষতি হবে না।’
এদিকে ঝড়ে আমসহ ফসলের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা থেকে জেলার চারঘাট, বাঘা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর ও বাগমারা উপজেলা ছিল বিদ্যুৎবিহীন। কোথাও ছিল না বিদ্যুৎ। তবে বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে চারঘাট ও বাঘা উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হলেও অনেক এলাকা এখনো রয়েছে অন্ধকারে।
এ দুটি উপজেলায় বিদ্যুৎ পুরোপুরি চালু করতে অনেক দেরি হবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি।
এদিকে আম কুড়াতে গিয়ে মোহনপুর উপজেলায় মনোয়ারা বেগম (৪২) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার হরিদাগাছি বারুইপাড়া গ্রামের ইসহাক আলীর স্ত্রী।
নিহতের স্বামী ইসহাক আলীর বরাত দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানওয়ার হোসেন জানান, রাতে ছোট মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন মনোয়ারা বেগম। ঝড় শুরু হলে কিছুক্ষণ পর পরিবারের সদস্যদের অগোচরে আম কুড়াতে যান তিনি। মেয়ে ঘুম থেকে জেগে মাকে না পেয়ে কান্না শুরু করলে অন্যরা বিষয়টি জানতে পারেন। পরে অনেক সময় পার হয়ে গেলেও মনোয়ারা বেগম বাড়িতে না আসায় তাকে খুঁজতে বের হয় তারা। বাড়ির পাশে আম গাছের নিচে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে। তবে তাঁর গায়ে স্পর্শ করার পর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যান। সেখান থেকে দ্রুত বাড়িতে আনার পর জানা যায় তিনি মারা গেছেন।
মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি তাঁর শরীরে কোনো আঘাতে চিহ্ন নেই। কোনো গাছ বা গাছের ডালও ভেঙে পড়েনি। কীভাবে তিনি মারা গেছেন, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’