মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর লাশ আটকে ছেলেকে পুলিশে দিল ইন্টার্নরা
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর স্ত্রী পারুল বেগমের চিকিৎসা অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। এই অভিযোগ এনে উচ্চবাচ্য করায় পারুল বেগমের লাশ আটকে রেখে তাঁর ছেলে রাকিবুলকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কাজে দেওয়ার অভিযোগ এনে রাজপাড়া থানায় মামলা করেছেন হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মামলায় মৃত পারুল বেগমের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী, তাঁর আরেক ছেলে মুস্তাফিজকেও আসামি করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী বলেন, তাঁর স্ত্রী পারুল বেগম (৬৫) মঙ্গলবার ভোরে নগরীর টিকাপাড়ার বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে সকাল ৭টার দিকে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান তাঁরা। সেখান থেকে পারুল বেগমকে পাঠানো হয় ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে তখন কোনো চিকিৎসক না থাকায় আধা ঘণ্টা পর রোগীকে ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় তাঁদের ছেলে রাকিবুল প্রথমে ওয়ার্ডে দায়িত্বরত শোভন সাহা ও পরে আবদুর রহিমকে তাঁর মাকে দেখার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের ডিউটি শেষ জানিয়ে রোগী দেখতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। এর আধা ঘণ্টা পর কোনো চিকিৎসা ছাড়াই পারুল বেগম মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন।
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী জানান, চিকিৎসা ছাড়াই মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় ছেলে রাকিবুল ওয়ার্ডের ভেতরে উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করে চিকিৎসকদের অভিশাপ দিচ্ছিলেন। এ সময় ইন্টার্ন চিকিৎসক শোভন সাহা ও আবদুর রহিম তাঁকে ওয়ার্ড থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় রাকিবুলের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। খবর পেয়ে অন্যান্য ওয়ার্ড থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা এসে রাকিবুলকে মারধর করেন এবং হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন।
এরপর মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক তাঁর স্ত্রীর লাশ নিয়ে যেতে চাইলে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা লাশ আটকে রাখেন। পরে দুপুর সোয়া ১টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়ে হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর লাশ নিয়ে যান। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দাবি অনুযায়ী পুলিশ রাকিবুলকে আটক করে রাজপাড়া থানায় নিয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা হাসপাতালের ডাক্তারদের যে ভয়ংকর চেহারা দেখলাম তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলবার নয়। যেখানে মানুষ বাঁচার জন্য আসে, সেখানে এঁরা কারা? কোন সমাজের মানুষ? জনসাধারণের কী সেবা দিচ্ছে তারা?’ বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
‘এতো অরাজকতার প্রতিকার কী? আমরা মুক্তিযুক্ত করে দেশ স্বাধীন করেছি এমন অরাজকতা আর ভয়াবহতা দেখার জন্য নয়।’
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী বলেন, ‘আমার ছেলেকে অন্যায়ভাবে ও ঘটনা সাজিয়ে ইন্টার্ন ডাক্তাররা পুলিশে দিয়েছে। সে তাঁর মায়ের মরা মুখটাও দেখতে পারবে না, এ কেমন দেশ?’
ঘটনা সম্পর্কে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতা মিজান চিকিৎসা অবহেলায় পারুল বেগমের মৃত্যুর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘পারুল বেগমের ছেলে রাকিবুলের হামলায় ইন্টার্ন ডাক্তার শোভন সাহা ও আবদুর রহিম আহত হয়েছে।’ তাঁদের জখমের ধরন কেমন, জানতে চাইলে মিজান বলেন, ‘তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়েছে।’
একই তথ্য দিয়ে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনন কান্তি দাস বলেন, ‘রোগী মারা যাওয়ার পর তাঁর স্বজনেরা ওয়ার্ডের ভেতরে চিৎকার করছিলেন। তাঁরা কর্তব্যরত নার্সদের উদ্দেশে বাজে কথা বলছিলেন। এ সময় একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক তাঁদের বাইরে যেতে বলেন। তখন ওই রোগীর ছেলে রাকিবুল চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলেন।’
মনন কান্তি দাস জানান, খবর পেয়ে তাঁরা যখন ওয়ার্ডে আসেন, তখন ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে রোগীর স্বজনকে আটকে রেখে মারধর করার প্রশ্নই আসে না।
তবে রাকিবুলে চাচাতো ভাই হায়দার আলী ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দাবি প্রত্যাখান করে বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই তাঁর চাচাতো ভাইকে মেরেছেন। তারপর পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তাঁর বাবা গিয়েছিলেন। তাঁকেও চিকিৎসকরা মারধর করেছেন।
ঘটনার পর ইন্টার্ন চিকিৎসকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন হাসপাতালের পরিচালক। সেখানে মামলার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুক্তার হোসেন সরকারি কাজে বাধা দানের অভিযোগ এনে রাজপাড়া থানায় মামলা দায়ের করেন।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাৎ হোসেন খান বলেন, ইন্টার্ন ডাক্তাররা ঘটনার পর থেকে হাসপাতালের সব ওয়ার্ডে চিকিৎসা বন্ধ করে বসেছিলেন। খবর পেয়ে আরএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে যান। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনেন। দুপুরের পর পারুল বেগমের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ছেলে রাকিবুলকে পুলিশ আটক করেছে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে সরকারি কাজে বাধাদানের মামলা করা হয়েছে। তবে পুরো ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক বলে মনে করেন তিনি।