মানিকগঞ্জে মরিচের পাতা কুঁকড়ানো রোগ, ক্ষতির মুখে চাষিরা
মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৬০ বিঘা জমিতে নানা জাতের মরিচের গাছে পাতা কুঁকড়ানো বা থুবড়া রোগ দেখা দিয়েছে। প্রতি বিঘায় শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মরিচের চারা এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মরিচচাষিদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে।
সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়নের রানাদিয়া, গোসাইনগর, বিশ্বনাথপুর ও বাংগোলা, তিল্লী ইউনিয়নের সলাইগোবিন্দপুর, জাগীর ইউনিয়নের উকিয়ারাসহ বিভিন্ন এলাকার মরিচক্ষেতে দেখা দিয়েছে থুবড়া রোগ। আক্রান্ত মরিচগাছের পাতা কুঁকড়ে গাছ মারা যাচ্ছে।
মরিচচাষিরা জানান, তিন সপ্তাহ ধরে মরিচক্ষেতে এই রোগ দেখা দিয়েছে। তাঁরা নানান কীটনাশক দিয়েও কোনো ধরনের প্রতিকার পাচ্ছেন না।
স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরও মানিকগঞ্জ জেলার কাঁচামরিচ রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও অন্যান্য বাজারে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়। এ ছাড়া বিদেশেও রপ্তানি করা হয় মানিকগঞ্জের মরিচ।
মরিচক্ষেত থুবড়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চাষি মো. রুবেল মিয়া জানান, গত বছরের চেয়ে এবার মরিচের চারা ভালো হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই দু-তিন সপ্তাহ ধরে মরিচক্ষেতে থুবড়া রোগ দেখা দেয়। বিভিন্ন রকম কীটনাশক দিয়েও এই রোগ সারাতে পারছেন না। এইভাবে চারা মরতে থাকলে মরিচ চাষের খরচ তোলাই সম্ভব হবে না।
সলাইগোবিন্দপুরের আরেক চাষি মো. নান্নু মিয়া বলেন, ‘আমার ২৭ শতাংশ জমিতে মরিচের চাষ করতে প্রায় ১৩ হাজার টাকা খরচ হইয়্যা গ্যাছে। গত বছরের চেয়েও কম খরচে প্রায় ২০ থেকে ২৫ মণ মরিচ পাইছিলাম। বর্তমানে যে হারে চারা মরতাছে তাতে কইরা এ বছর এই ক্ষেত থেইক্যা দুই-তিন মণ মরিচ হইবার পারে।’
এ ছাড়া গড়পাড়া ইউনিয়নের আরো দুটি গ্রাম রানাদিয়া ও গোসাইনগরের চাষি রজ্জব আলী (৬০) ও নূরজাহান বেগমের (৫৫) ক্ষেতেও থুবড়া রোগ ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। মরিচের ফলন সম্পর্কে জানতে চাইলে নূরজাহান বেগম বলেন, ‘গতবার পাঁচ ডিসিম (৫ শতাংশ) জমি থেইক্যা প্রায় ৮ থেকে ১০ মণ মরিচ বেচছি। এবার থুবড়ার কারণে প্রায় সব চারাই মইরা গ্যাছে। এহন যে কয়ডা চারা আছে, তা থেইক্যা নিজেগো খাওনের মরিচ হইবার পারে।’
অন্যদিকে গড়পাড়ার সবজি চাষে খ্যাত এলাকা বিশ্বনাথপুরের বাংগোলার চাষি নুরুল ইসলামের চোখে লোকসানের হতাশা। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিবছরই মরিচ করি। গতবারের চেয়ে বেশি ফলনের আশায় এবার জমির পরিমাণও বাড়াইছি। শিখা, লংকাগ্রিন ও ঝিলিক মরিচ বুনছি। কিন্তু চারায় ফলন আসার পর হঠাৎ করেই দুই সপ্তাহ ধরে ক্ষেতে থুবড়া রোগ দেখা দিছে। বিভিন্ন রকমের কীটনাশক দিয়্যাও এই রোগ সারাইবার পারি নাই। এইভাবে চললে সপ্তাখানেকের মধ্যে পুরা খ্যাত (ক্ষেত) নষ্ট হইয়্যা যাইব।’
‘সরকার যদি আমাগো এই রোগ সম্পর্কে আগে থেইক্যাই ধারণা দিত বা ট্রেনিং দিত, তাইলে আমরা কৃষকেরা অনেক উপকার পাইতাম। তা ছাড়া নানান রকমের কীটনাশক বিনামূল্যে বিতরণ করলে গরিব কৃষকদের উপকার হইত।’
স্থানীয় কীটনাশক বিক্রেতা মো. ফরিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা জানি প্রতিবছরই মরিচক্ষেতে থুবড়া রোগ দেখা দেয়। সেটা শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ; কিন্তু এবার প্রায় সব ক্ষেতেই ৭০ ভাগ থুবড়া রোগ দেখা দিয়েছে। আমরা লোকাল কীটনাশক বিক্রেতা হিসেবে সানমেট্রিট, কুমুলাক্স, রিবলেল, ক্যাব্রিয়টন, ইমিটাপ ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে থাকি। প্রায় সময়ই দেখা যায় এগুলো দিলে থুবড়া রোগ চলে যায়। কিন্তু চাষিরা বলছেন, এবার নাকি রোগ যাচ্ছেই না!’
এদিকে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আফতাব উদ্দিন মাহমুদ জানান, এ বছর সদর উপজেলায় ১১৬ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ পর্যন্ত ৮৯ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। তিনি সরেজমিনে জাগীর ইউনিয়নের উকিয়ারা গ্রামে গিয়ে মরিচের থুবড়া রোগ দেখতে পেয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা, এটি ভাইরাসজনিত। এই রোগের উপদ্রব যেন কম হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, যদি ভাইরাসের কারণে মরিচগাছের পাতা কুঁকড়ানো রোগে আক্রান্ত হয়, তবে গাছগুলোকে বাঁচানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আফতাব উদ্দিন মাহমুদ আরো বলেন, ‘মরিচ চাষের জন্য কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চাষিদের কোনো প্রকার উপকরণের সহায়তা দেওয়া হয় না। তবে জৈব ও রাসায়নিক সারে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দেওয়ার বিধান আছে।’
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, কিছু কিছু এলাকায় মরিচের থুবড়া রোগ বা পাতা কুঁকড়ানো রোগ দেখা দিয়েছে এবং সে বিষয়ে কৃষকদের মধ্যে বিভিন্ন কীটনাশক ও ওষুধ প্রয়োগেরও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে জেলা কৃষি অধিদপ্তর।