মানিকগঞ্জে বন্যায় কৃষকের মাথায় হাত
যমুনা নদীর পানি মানিকগঞ্জের আরিচা পয়েন্টে কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির আশায় বুক বাঁধছে এখানকার বানভাসি মানুষ। জেলার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা ও ইছামতি নদীর পানি এখন স্থিতিশীল। এসব নদ-নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে।
এদিকে দিন যতই গড়াচ্ছে এখানকার পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ যেন বেড়েই চলেছে। তবে বন্যার পানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এ অঞ্চলের ফসলি ও সবজি চাষিরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলা সদরসহ দৌলতপুর, সাটুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের ফসলি জমি ও সবজি বাগান পুরোপুরি পানিতে ডুবে গেছে। বন্যার শুরুতেই তাদের চোখে ভবিষ্যতের দুর্ভোগের ছবি নেমে এসেছে। অনাগত ভবিষ্যতে কতটা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে সেটাই তাদের এখন একমাত্র ভাবনা।
কান্নাভেজা চোখে দৌলতপুর উপজেলার ধামশরের বদির উদ্দিন বন্যায় তাঁর নিঃস্ব হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিন বিঘা জমির সবটুকু ভুট্টার ক্ষেত ডুবে গেছে। সেইসঙ্গে তলিয়ে গেছে আরো তিন বিঘা জমির বেগুন, কলার বাগান ও অন্যান্য শাক-সবজি। প্রায় তিন লাখ টাকার ক্ষতি হবে। এটা অনেকটাই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না চাষি বদির উদ্দিন।
মানিকগঞ্জ সদর, ঘিওর, শিবালয়, দৌলতপুর, হরিরামপুর ও সাটুরিয়ায় ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চলের জমিতে বন্যার পানি প্রবেশ করে প্রায় সম্পূর্ণ কৃষিজ ফসল ও সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে ।
দৌলতপুরের ধামশর ইউনিয়নের কাপসাইল গ্রামের হাসিনা বেগম (৫০) জানান, ৪০ শতাংশ জমিতে শশা, ঢেড়শ, চাল কুমড়া, ধুন্দল, বেগুন ও মিঠা পটল বুনেছিলেন প্রায় লাখ টাকার বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে। সবজিও হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু বন্যার পানিতে সব সবজি তলিয়ে যাওয়ায় তাঁর স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে।
ইতোমধ্যে ৪০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে এসব সবজি ভালোই বিক্রি করছিলেন বলে জানান হাসিনা বেগম।
অপরদিকে একই গ্রামের আল-মামুনুর-রশিদ প্রায় পাঁচ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন সবজিবাগান ও মুরগির খামার। বন্যায় তলিয়ে গেছে পেঁপে, আদা, বেগুন, লাউসহ নানান সবজি। সেইসঙ্গে তিনি আতঙ্কিত আছেন মুরগির খামারটি নিয়ে। কেননা এরই মধ্যে বন্যার পানি খামারের মেঝেতেও ঢুকতে শুরু করেছে। বিভিন্ন পোকামাকড় ও সাপের দংশনে মুরগির জীবন নাশের আশঙ্কা করছেন তিনি।
এ ছাড়া রশিদ জানান, এবার বন্যার কারণে তাঁর খামারে ডিমের খরিদ্দাররাও আসতে পারছে না। পানি আরো বৃদ্ধি পেলে মুরগিগুলোকে অন্যত্র সরাতে হবে। কিন্তু কোথায় সরাবেন এটাই এখন ভাবার বিষয়।
জেলার সিংগাইর উপজেলা ছাড়া প্রায় সব অঞ্চলই প্লাবিত হয়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে বানভাসি মানুষ এখন আশ্রয় নিচ্ছে উঁচু রাস্তায়, বিভিন্ন স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রে। বানভাসি এই জনগোষ্ঠীর আশ্রয় মিললেও ফসল ও সবজির বাগানকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এ অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে চলতি বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার ব্যাপক ক্ষতি।
সাইফুল ইসলাম শামীম তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা ও দেড় বিঘায় পাট চাষ করেছিলেন। কিন্তু চাষ করা কোনো ফসলই তিনি ঘরে তুলতে পারেননি। তাঁর ধারণা ছিল, পানি কমতে পারে। অথচ কয়েকদিনের ব্যবধানে পানি বৃদ্ধির ফলে পাট ও ভুট্টা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
শামীম জানান, বাড়ির কাছেই প্রায় ২৫ শতাংশ জায়গায় সবজির আবাদ করেছিলেন। যেখানে চাষ করেছিলেন লাল শাক, বেগুন ও কুমড়া। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেগুলোও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
শামীম আরো বলেন, চাষিরা বন্যায় যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, সেটা বন্যা পরবর্তী সময়ে সরকার যদি তাদের কিছুটা সাহায্য করে তবে হয়তো এই ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবেন।
এদিকে তিন থেকে চার লাখ টাকার ভবিষ্যৎ ক্ষতি গুনছেন মোয়াজ্জেল হোসেন (৭০)। প্রায় সাত লাখ টাকা ব্যয়ে জমিতে মাটি ভরাট করে বিশাল বরই (আপেল বরই) বাগান করেছিলেন। সেইসঙ্গে চাষ করেছিলেন পুঁই শাক। এখন সবই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহজাহান আলী বিশ্বাস মুঠোফোনে বলেন, এবার মানিকগঞ্জে প্রায় ৪৫ হাজার ৬৫০ হেক্টরের বেশি জমিতে ফসল উৎপাদন লক্ষমাত্রা ছিল। পদ্মা ও যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় এবার পানি বৃদ্ধির ফলে বোরো আমন ও আউশ ধান, ভুট্টা, পাট, তিল, সবজিচাষিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।